লিখেছেন: যিশু মহমমদ
‘জাগো ফাউন্ডেশ’ নামের একটা ‘হলুদ’ কর্মকাণ্ড হয়ত সকলেরই চোখে পড়ছে। উদ্দোগটা ভালো। শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে এন.জি.ও–সাংস্কৃতিক ধারার কাজ। যেমন ভিন্ন আদলে এই ধরণের কাজই করে হাঙ্গার প্রজেক্ট, প্রথম আলো বন্ধুসভা ইত্যাদি সংগঠন গুলো–। সাথে কিছু বামপন্থীদের কাজও এর বেশী দূর গড়ায় না; বিচার–বিশ্লেষণ করলে তাই দাঁড়াবে। বিষয় গুলো শেষ পর্যন্ত মানবিকতা বোধ জাগ্রত করার নামে বা সমাজ সেবার নামে অথবা হোক– সমাজ পরিবর্তনের নামে তাতে কিছু যায় আসে না। কেননা এসব প্রকারন্তে ভূখা–নাঙ্গা, প্রত্যহ আধপেট খাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর উত্থান যেনবা না ঘটে সে মতলব এঁটে রাখা। সমাজে ঘোলটে অবস্থান তৈরী করা। এটা নতুন কিছু নয়, বুর্জোয়া সমাজের অনেক গুলো চালাকীরই একটা অণু নমুনা। ‘জাগো ফাউন্ডেশ’ নামের ‘হলুদ’ কর্মকাণ্ডটি– কথিত তৃতীয় বিশ্বের বঙ্গ দেশে ‘আরব বসন্ত’ বা ‘Occupy Wall Street’এর মত কোন আপাত বিপদ না ঘটে সে প্রচেষ্টাতে ঘোল ঢালার সচেতন উদ্দেশ্যে না হলেও এটি মূলত সমাজে–বৈষম্যের গতরে পালিশ দেয়া, সমণ্বয় সাধন করা। সবে মাত্র শুরু নয়, এর বীজ রোপা আছে প্রায় তিন দশক ধরে।
কিন্তু সুক্ষভেদ বিচারে খেয়াল রাখা উচিত, বাংলাদেশে এনজিও তৎপরতা গুলোকে জনহিতকর কর্ম বলে প্রচারিত করার চেষ্টা আজঅব্দি জারি থাকলেও কার্যত এটি সাম্রাজ্যবাদি চক্রান্ত কার্যকর করারই উদ্দেশ্য। বিশেষতঃ মধ্য শ্রেণীর ভদ্দরনোক অর্থাৎ সুশীল সমাজের চিন্তাপদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টির কৌশল হিসেবে এসব বেশ উপদেয়। ‘সমাজ’ খায়ও বটে। অনেক রাজনীতিক সংগঠনও এই এনজিও ঘারানা, সুশীল সমাজ– যা আদতে বুর্জোয় চক্র সেসব মতাদর্শের বাইরের কিছু নয়। সেদিক থেকে আমাদের দেশে ‘জাগো ফাউন্ডেশ’এর কার্যক্রম বলি আর বিপ্লবী ধাঁচে ‘আরব বসন্ত’ বা ‘Occupy Wall Street’এর মতন কোন আন্দোলন দাঁনা বাঁধলে আপাতদৃষ্টিতে তা বৈপ্লবিক মনে হলেও(তাতে কারা ব্যাপক হারে অংশগ্রহন করার বাস্তবতা আছে?) কৃষক–শ্রমিক শ্রেণীর দিক থেকে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি কিনা(আমাদের বাস্তবতায়) –এসব আমাদের তুলনামূলক–পর্যালোচনা করে দেখা উচিত। ছিঁটেফোটা বিপ্লবী উপাদান আছে বটে তবে তা ‘প্রধান’ মনে করার সুযোগ আছে কিনা ভেবে দেখা উচিত। কেননা, শাসক শ্রেণী এও চায় যে, বাংলাদেশের মতোন দেশে নিন্মবের্গর জনগণের রাজনৈতিক–সংস্কৃতিক দিশাহীন অবস্থা টিকিয়ে রাখার ভেতর দিয়ে এবং মধ্যবিত্তীয় কূপমণ্ডুক রাজনৈতিকতা বোধকে কাজে লাগিয়ে যেসব ‘নাগরিক–আন্দোলন’ দানা বাঁধবে তা বড় জোর বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্য’ই সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করবে। যা শাসক গোষ্ঠির ও পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের জন্য মাঝে মাঝে ভিষণ প্রয়োজনীয় বটে।
আমারা জানি যে, বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের বহুরূপী আনাগোনা আছে। কখনো জনগণের কাছে এদের সুরুত জানা আছে, কখনো এই ধূর্তরাই দেবতুল্য পূঁজো পায়। গরীবের বন্ধু, নারী মুক্তির আগ্রদূত, তরুণ সমাজের নায়ক থেকে শুরু করে নানা বিশেষণেই এদের চিনপরিচয় খেয়াল করলে দেখতে পাব। এসব ভাবমূর্তি গুলোর ‘ভাব–সাব’ ধরতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। বিনয়ের সহিত বলছি আমার সেই শৌর্য–বীর্যের অভাব আছে। তবে গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের, কমিউনিষ্টদের এসব ঘোলাটে বিষয়ের প্রতি নজর খাড়া রাখা কর্তব্য বটে। যেমন: বড় হরপে ড. ইউনূচের ‘সামজিক ব্যবসা’ আর ছোট হরপে হলেও ‘জাগো ফাউন্ডেশ’ নামের হলুদ কর্মকাণ্ড গুলোকে দাগিয়ে দেখার দরকার আছে বৈকি।
মূলত, এই দেশে সাম্রাজ্যবাদ এনজিও দিয়ে ও এনজিও আদলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ও পৃষ্টপোষকতা দিয়ে লগ্নি পুঁজির কায়কারবারকে সহজ করে তুলেছে। সাম্রাজ্যবাদি শক্তির এ কৌশলের বড় গুঁটি এতদিন ছিল ড. ইউনূচ; সে খুঁটি অনেকটাই নড়েচড়ে গেছে। কিন্তু খুশি থাকার কিছু নেই কেননা, সাম্রজ্যবাদের কৌশলের দিকে নজর দিলে বোঝা যায় এর আরো কয়েকটি ভেংচি(ভঙ্গি) আছে। দুনিয়া জুড়ে নানান ভেকবাজিতে উপস্থিত হবার কৌশল রপ্ত করেছে সে। এই সাম্রাজ্যবাদ একই সঙ্গে রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক, মতাদর্শিক এবং পরিবেশগতও। কোথায় সে বোমা–বারুদ নিয়ে শরীরের উপর হামলে পড়ে, কোথায় সে মগজের ভেতর ঢুকে পড়ে। কোথায় দুটি কৌশলই পরষ্পর সম্পর্কিত। মগজের ভেতর ঢুকে পড়াটা হচ্ছে সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক কৌশল। কৌশলটা হচ্ছে, সামগ্রিক ভাবে সমাজের বিরাজনৈতিকিকরণ ঘটানো, বা এভাবেও বলা যায় যে, জনগণের রাজনৈতিক চেতনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা এই কৌশলের উদ্দেশ্য। সুশীল বা অরাজনৈতিক এবং অনেকক্ষেত্রে রাজনীতিক নামধারী সংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে পুঁজিবাদের ইচ্ছাকে কার্যকর করা। মোটাদাগে এতে সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।
তাই এতদিনের নির্লিপ্তভাবেই গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক ‘কৌশল’ এখন বিভিন্ন ভাবে বহিঃপ্রকাশ ঘটার সময় এসেছে; যদিও অনেক দিন ধরেই তা ঘটছে। এই ‘কৌশল’ বুদ্ধিজীবীর তৎপরতা থেকে শুরু করে নাট্যকর্মীর কাজের ভেতর দিয়ে– সর্বস্তরে এই প্রক্রিয়া সচল রাখার মতো দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। এমনকি, হয়ত আমরা ‘চিন্তা–পদ্ধতি ও কর্মসূচী’ খেয়াল করলে টের পাবো বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন গুলোও এর বাইরে পড়ছে না; হতে পারে তারা আন্তরিক। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বক্তব্য, কার্যকলাপ, মতাদর্শ ইত্যাদি বিচার করলে দেখবো প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে টিকে থাকতে সাহায্য করছে। এবড় লীলাময়। যা প্রকারন্তে বুর্জোয়া খেদমতে নিয়োজিত থাকা। অর্থাৎ বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরোদ্ধে ব্যাপক ভাবে সংগঠিত হবার সম্ভবনাতে পিছিয়ে পড়া, গোঁলক ধাঁধায় আটকে থাকা।
এটা সত্য যে, দিনকে দিন শোষন নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ও শ্রেণীর মধ্যে আগের তুলনায় ক্ষোভ দানা বাঁধছে। দাস তার দাসত্ব টের পাচ্ছে। কিন্তু ক্ষোভ গুলো যেন বিপ্লবী ক্রোধে পরিণত না হতে পারে, বিপ্লবী রাজনৈতিকতা যেন সক্রিয় হতে না পারে তার জন্য সাম্রাজ্যবাদী সাহায্যপুষ্ট এনজিও তাদের নিরবিচ্ছিন্ন পরিকল্পনা বিস্তৃত করেছে অনেক দিন ধরেই। প্রথম ধাপ হিসেবে গ্রামাঞ্চলে খুঁটি গেড়েছে ঋণ কর্মসূচী প্রণয়ন করে। এভাবে কৃষক–শ্রমিকের ভেতর সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে একান্ত করে তুলেছে। আর তা রক্ষার জন্য দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে নিন্মবিত্ত–মধ্যবিত্ত বিভিন্ন অংশের ভেতর শিক্ষা কমসূচী, সাংস্কৃতি সংগঠন, নারী আন্দোলন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপ, জঙ্গি–সাম্প্রদায়িকতা–মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনকে পৃষ্টপোষকতা ও পরিচালনা দুই করছে। অর্থাৎ প্রগতিশীলদের, গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের, এমনকি আন্দোলনের ফ্রন্ট হিসেবে কমিউনিষ্টদের অস্ত্র গুলোকে বুমেরাং করে তুলছে।
একদিকে নিখাদ সুশীল সমাজ, এনজিও তাদের সাংস্কৃতিক ও মতদর্শিক পরিকল্পনা আরেক দিকে বিভিন্ন ভাবে রাজনৈতিক–সংগঠনিক কার্যকলাপের ভেতর দিয়ে শাসক গোষ্ঠির (হয়ত অজান্তেই) কৌশল বয়ে বেড়াচ্ছে যারা তাদের ব্যাপারে প্রত্যেক কমিউনিষ্ট হয়ে উঠতে চাওয়া, সরল ভাবে বললে, রাজনৈতিক হয়ে উঠতে চাওয়া কর্মীদের সচেতন থাকা জরুরী। এই বিবেচনায় রাজনৈতিক কাজের ভেতর দিয়ে এবং একই সাথে ‘অরাজনৈতিক’–সুশীল সমাজের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এলোপাথাড়ি, অবাস্তব, স্ব–বিরোধী চিন্তা ও কাজের যেসব বহিঃপ্রকাশ ঘটে তার সূত্রায়ন অবশ্যক।
‘জাগো ফাউন্ডেশ’ এর সমাজেসেবা মূলক কর্মকাণ্ড আর বিপ্লব ও অবিপ্লবী নামধারী রাজনৈতিক–সংগঠনের কাজকে একই দাগে ফেলছি ভেবে কেউ যদি মুখ ঘুরিয়ে থাকেন তবে আমি মূলত পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠানিক প্রকরণ সাম্রাজ্যবাদের কৌশলের বিস্তারকে ইঙ্গিত করতে অক্ষম হয়েছি। ব্লগিয় পরিসরে সংক্ষেপে বলার বিপদ মাথায় নিয়েও তবু যতটুকু সরলভাবে উপস্থাপন করা যায় তা চেষ্টা করলাম।
যেমন: অনেক বামপন্থা দায়বোধ করেন, ঠিক এদের (উচ্চ ও উচ্চ–মধ্যবিত্ত তরুণদের) কিভাবে কাজে লাগানো যায়। উদার ভাবে আমরা মেনে নিলাম, এটা তাদের কৌশল হতে পারে। মধ্যবিত্ত অংশগ্রহনের সাথে সাথে নিন্মবিত্তের যুবকদের আন্দোলনে অংশগ্রহন ও নেতৃত্ব নিশ্চত করা ‘কমিউনিষ্ট’দের একটা কাজ বটে। কিন্তু নিন্মবিত্তকে খুব একটা রাজনৈতিক অংশগ্রহনের ও নেতৃত্বের গুরুত্বে না নিয়ে স্বল্প সংখ্যক মধ্য ও উচ্চবিত্তের তরুণদের ‘ব্যপক’ অংশগ্রহন আকাঙ্খি বাম–সংগঠন গুলোর দৃষ্টিভঙ্গিকে যাচাই করার দরকার আছে। যে সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিন্মবিত্তের তরুণ বিপ্লবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার মতো জোর–সক্ষমতা রাখে সে সমাজে মধ্য ও উচ্চবিত্তের সংখ্যালঘিষ্ট তরুণদের বাহিনী বানিয়ে শেষতক কিছু মাত্রায় – নামে মাত্রা ‘নাগরিক সংকট‘ উর্ত্তীণ হওয়া গেলেও তা (শ্রেণী)বিপ্লবের পথ ও কাজ ও পদ্ধতি কিনা নিরীক্ষণ করার দরকার আছে। নাগরিক সমাজের আন্দোলন গড়ে তোলা কমিউনিষ্টদের রণ-‘কৌশল’ হতে পারে, এর সাথে শ্রেণী–সংগ্রামের ‘নীতি’কে গুলিয়ে ফেলা কতটুকু সদা সত্য তা বিবেচনার দাবী রাখে।
এসব দিক বিবেচনায়– জাগো ফাউন্ডেশ, কোয়ান্টাম মেথড, হাঙ্গার প্রজেক্ট (ইযূথ এণ্ডিং), প্রথম আলো বন্ধুসভা, দূর্নীতি বিরোধী আন্দোলন, সুজন (সু শাসনের জন্য নাগরিক), সৎ ও যোগ্য প্রার্থী আন্দোলন ইত্যাদি কল্যাণকর ও অরাজনৈতিকতার নামে পুঁজিবাদের এ কৌশল গুলোর অঙ্গ যারা এবং যারা রাজনৈতিক–সাংগঠনিক তৎপরতার মধ্যদিয়ে হালে পানি দিচ্ছে(মতাদর্শিক বিবেচনায়)- সব মিলিয়ে ঘোষিত ও অঘোষিত উদ্যোগ গুলোর বিপদজ্জন বিশেষত্বকে রাজনৈতিক কর্মীর ধর্ত্যব্যে নেয়া উচিত।।
(প্রথম প্রকাশ: উন্মোচন ব্লগে)
‘জাগো ফাউন্ডেশন‘ নিয়ে মঙ্গলধ্বনি‘তে প্রকাশিত আরো দু‘টি লেখার লিঙ্ক–
http://wp.me/p1T4sZ-5K