নব্বইয়ের কবিতার চিত্রকল্প

মাতিয়ার রাফায়েলের ‘অমর, মর…’ এবং আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ

লিখেছেন: আহমদ জসিম

জেনগল্প হৈতে প্রবাহিত

বহুদিন আগে একবার তাহার ছেলেসন্তান কী মরুভূতে নরবাণিজ্য

উদ্দেশে গিয়ো ফিরিয়া আসে নাই আর। তাহার কথাই মনে টানিয়া

বারঙবার গ্রামবৃদ্ধাটি কী গানসহিত মিতদীর্ঘশ্বাস প্রবাহে যায়

সেদিনও লামা পাহাড়ের পাদদেশের বাঁশঝাড়মধ্য হৈয়া রামদা হাতে আঁকিয়া বাঁকিয়া সরিতেছিলেন টীলাবাসিনী পোঁদশ্রেণীস্থা সেই গ্রাম বৃদ্ধাটি।

ছেলেটির জন্ম প্রাক্কালে যেতুরীয়সঙ্গম জঙ্গমতায় ধ্বনিত হৈত কণ্ঠ হৈতে তাহার, ওঁ, এই ওঙ্কার বিশেষ, তামাদি হৈয়া যাওয়া কোন অন্দর যেভগ স্ফূর্তিতে ছিল বান্, সেই পুরুষ শায়ক,

তাহার ভগবানপুরুষ, মরিয়া হাজিয়া পগার পার সেই কবে, সেই বাঙলা তেরশ’ কত যেন বন্যার পূর্বে

গ্রামবৃদ্ধার স্মৃতি প্রবাহে তাহেই কী দীর্ঘশ্বাসে মৃদু মৃদু ধাক্কা খাইতে খাইতে আবার সরিয়া সরিয়া পড়িয়া যায়।

তখনই মাত্র লুটিয়া প’ড়ে স্মৃতিতে আবার কী যে মিহি টানে সেই ওঁ, ওঙ্কার ধ্বনিপর : ‘ওঁমর, মর’

তাহারই ধারাবাহিকতায় এক বর্ষাদিবস চোখে চষিয়া গেল চকিতে আমার, এক পঞ্চাশীতিপরায়ণা প্রায় ধনুকায় ধনুকায় গ্রামবৃদ্ধাবাছিয়া বাছিয়া কচু কাটিতেছে।

আর ধ্বনিত হৈতেছে কণ্ঠ হৈতে, তাহারই যেন কোন অর্ধস্বর ভাঙিয়া, ‘ওঁকচু। অঁমর, ওঁমর’

আচম্বিতে কী জাদুগ্রস্তের মতো তদীয় পার্শ্বস্থিত হৈয়া কৈলাম : কী হে গ’ পোঁদে, কী শোধে কাহাকে তুমি ওমন অভিসম্পাৎ করিতেছ, ওঁকচু, অঁমর, ওঁমর

পোঁদবৃদ্ধাটি যারপরনাই লজ্জাপর কৈল, বিদেশী বাবু, মুই ত কেউরে কোন শোধে এইসা অভিসম্পাৎ করিচ্চি না!

ছেলে আমার অমর, বহুদিন আগে নরবাণিজ্যে গিয়া ধর্মান্তরিত হৈয়া গিয়া ফিরিয়া আসে নাই আর এ মাতৃকোলে কোনদিন!

কী নতুন নাম না কি হৈয়াছিল তাহার, অমর হৈতে ওমর, বাবুজি গা’, মুই ত তাহাই ধৈরা ডাকিচ্চি,

অঁমর, ওঁমর’

 

শ্রুতিময়তা ও ছান্দিক শুদ্ধতাকবিতার জন্য কোন বিষয়টি প্রধান? কাব্যবোদ্ধা পণ্ডিতগণের মধ্যে এবিষয়ে বির্তক বহু পুরোনো। নদীর বহমান স্রোতের মতো কবিতা সবসময় গতিশীল। কখনও স্থির থাকেনি শিল্পকলার এই প্রাচীন মাধ্যমটি। মার্কসীয় সাহিত্যের সুপণ্ডিত লেখকগবেষক জজ টমসন তাঁর মার্কসবাদ ও কবিতা গ্রন্থে প্রমাণ করে দিয়েছেন, পৃথিবীর সর্বাধিক প্রাচীন ও পরিশীলিত কবিতা হচ্ছে গ্রিক, ইংলিশ ও আইরিশ কবিতা; আর এই তিন কবিতার মধ্যে ইংলিশ কবিতা বাদ দিয়ে বাকি দুই কবিতারই প্রচীন নিদর্শন হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ততা (অনেকটা আমাদের কবিগানের মতোই। বোদ্ধাপাঠক, যখন জজ টমসনের মার্কসবাদ ও কবিতা গ্রন্থের উদাহরণ আনছি, তখন আপনারা বলতেই পারেন, কেমন মূর্খতা! পাঠক, আপনাদের মতো আমারও মনে আছে, জজ টমসন কিন্তু পরবর্তীকালে উক্ত গ্রন্থের সাথে দ্বিমত পোষণ করে গ্রন্থটা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে আমার মতো সারা পৃথিবীর বিপুল পাঠক তাঁর মতের প্রতি আস্থা রেখে ফেলেছে।), পরবর্তীকালে প্রাচ্যের কবিতা স্বতঃস্ফূর্ততার খোলস ছেড়ে পরিণত হয়েছে গভীর ভাব ও ভাবনার বিষয়। কিছুকিছু কবিতা তো ছন্দকে ছুড়ে ফেলে এমন রূপ নিয়েছে যে কবিতা হিশেবে উল্লেখ না করলে বোঝার উপায় থাকে না এটা কবিতা, না কি গদ্য। কিছু কবিতা তো পড়তে গিয়ে রীতিমতো ধাঁধায় পড়তে হয়- এটা কি অনুগল্প, না প্রবন্ধের অন্য রূপ! তো, মাতিয়ার রাফায়েলের কবিতা ‘অমর , মর…’ এই ধাঁচের কবিতা। কবিতা নিয়ে বলার আগে কবি সম্পর্কে দু’চার কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছি। মাতিয়ার রাফায়েল কবিতা লেখা শুরু করেছেন নব্বইয়ের গোড়া থেকে। তবে তাঁর সমসাময়িক কবিদের তুলনায় তিনি অনেকটা নিভৃতচারী ও অন্তর্মুখী। শব্দদু’টো আমাকে লিখতে হল, কারণ নব্বইয়ের যেক’জন কবিকে আমি কাব্যশক্তিধর বলে বিবেচনা করি, তাঁদের মধ্যে রাফায়েলের প্রকাশপ্রচারণা অস্বাভাবিকভাবে কম। সত্য বলতে কী, রাফায়েলের সাথে ব্যক্তিগত পরিচয়ের পর আমি তাঁর কবিতা পড়তে শুরু করি। তাঁর কবিতা পাঠের প্রক্রিয়া হিশেবে আমার মনে যেদু’টো প্রশ্ন বারবার এসেছে: প্রথমত, ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের কতটা প্রভাব থাকে একজন কবির কবিতায়? দ্বিতীয়ত, গভীর ব্যাপ্তির কবিতা কি সরল ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব? প্রথম ভাবনাটা এসেছে কবির সাথে ব্যক্তিগত পবিচয়ের পর, আর দ্বিতীয় ভাবনা এসেছে কবির কবিতা পাঠের পর।

আসলে অমি যখনই মাতিয়ার রাফায়েলের কবিতা পাঠ করার জন্য হাতে নেই, পাঠের পূর্বপ্রস্তুতি হিশেবে প্রথমেই খুঁজে নিই বাংলা অভিধানটা। অভিধান ছাড়া যেক’বার তাঁর কবিতা পড়ার চেষ্টা করেছি, তত বারই তাঁর কবিতা আমার মাথায় না ঢুকে শোঁশোঁ শব্দ করে মাথার উপর দিয়েই চলে গেছে। তো, মাতিয়ার রাফায়েলের ’অমর, মর…’ কবিতাটি কাব্যমানে অসম্ভব উৎকৃষ্ট হলেও বাক্যচয়নে সহজাততার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘অমর, মর…’ কবিতাটি আমি পড়েছি ছোটকাগজ লোকএর একাদশ সংখ্যায়। এদীর্ঘ গদ্যকবিতার বিষয়বস্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের লামাবাসী এক বৃদ্ধা নারী, যাঁর পুত্র জীবনমান উন্নয়ন অথবা নিশ্চিত জীবনের তাগিদে (কবির ভাষায় ‘নরবাণিজ্য’) নিজস্ব ধর্মসংস্কৃতি থেকে বিযুক্ত হয়ে নতুন ধর্মসংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যার জন্য সেই গ্রামবৃদ্ধার শোক। পাঠক, ‘মর ওমর…’ কবিতাটি সম্পর্কে আমার যেঅভিব্যক্তি প্রকাশ করলাম, বস্তুত কবিতার বিষয় ও ব্যাপ্তি তার চেয়ে আরও বিশাল। কবিতার বিষয়বস্তুটা কোনো উপন্যাস, নিদেন পক্ষে গল্পের পটভূমি হতে পারত। কবি শুরু করেছেন এমন উচ্চারণ রেখে: ‘জেনগল্প হৈতে প্রবাহিত।’ কবি, বোধ করি, নিজেও কবিতাটি শেষপর্যন্ত গল্পে পরিণত হচ্ছে কি না- এব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। ওই যে বললাম, কবিতা এখন আর নির্দিষ্ট ফর্মে বন্দি নেই- যুগেযুগে সৃষ্টিশীল কবিরাই কবিতার আকৃতি ও প্রকৃতিতে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছেন। তো, পাঠক, আমরা এবার একবিতার বিশেষবিশেষ পঙ্ক্তির দিকে একবার নজর দিতে পারি।

সেদিনও লামা পাহাড়ের পাদদেশের বাঁশঝাড়মধ্য হৈয়া রামদা হাতে আঁকিয়া বাঁকিয়া সরিতেছিলেন টীলাবাসিনী পোঁদশ্রেণীস্থা সেই গ্রাম বৃদ্ধাটি।

টীলাবাসিনী’ শব্দটি দিয়ে বুঝে নিলাম, বৃদ্ধা আসলে আদিবাসী নারী। তবে ‘পোঁদশ্রেণীস্থা’ অর্থ কী হতে পারে? পাঠক একটু লক্ষ করুন, শব্দ নিয়ে কী অদ্ভুত খেলা! সমগ্র বাংলাদেশের কোনো জনপদে ‘পোঁদশ্রেণী’ নামে কোনো সম্প্রদায় আছে বলে আমার জানা নেই, তাহলে এই ‘পোঁদশ্রেণীস্থা’ মানুষ কারা? বৈদিক ভারতে আর্য কর্তৃক সৃষ্ট হিন্দুধর্ম, যেধর্মে মানুষকে বিভাজন করেছে চারটি শ্রেণিতে; ওই ধর্মমতে অস্পৃশ্য শুদ্রের জন্ম হয়েছে ব্রহ্মার নিুাঙ্গ দিয়ে। হয়তো কবি এই ‘পোঁদশ্রেণীস্থা’ শব্দটি ‘নিুবর্গের মানুষ’ অর্থেই ব্যবহার বরেছেন। কাব্যে ধর্মপূরাণের কার্যকর প্রয়োগ। এখানেই মাতিয়ার রাফায়েলের বিশেষত্ব। কবিতায় শব্দ নিয়ে খেলতে পারার মুনশিয়ানা।

প্রথমেই উল্লেখ করেছি, মাতিয়ার রাফায়েলের ‘অমর ওমর…’ কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আধার; যেবিষয় নিয়ে একটি বিশাল উপন্যাস লেখা যেত, নিদেন পক্ষে একটি গল্প, সেবিষয়কে তিনি একটি কবিতায় ধারণ করতে পেয়েছেন। কোনো অদক্ষ কবির হাতে পড়লে বিষয়টি কবিতা না হয়ে লিফলেট হয়ে যেত। আবার ব্যাপারটা এমন না যে আদিবাসীদের নিয়ে মাতিয়ারই প্রথম লিখলেন। সম্প্রতি বরং তথাকথিত উন্নয়নকর্মী ও সম্রাজ্যবাদনির্ভর মানবাধিকারসচেতন ভাবুক, লেখক, গবেষক, বুদ্ধিজীবীদের কাছে আসিবাসীদের বিষয়আশয় নিয়ে কাজ করার ব্যাপারটা বেশ আদরণীয় হয়ে উঠেছে, সেই সাথে মিশনারি তৎপরতা তো আছেই। এই গোত্রভুক্ত পোষা লেখকবুদ্ধিজীবীদের বাইরে থেকে ইদানীং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী নারীপুরুষ লেখালেখি করছেন। কিন্তু তাঁদের কারও লেখাতেই তো রাফায়েলের ‘অমর, মর…’ কবিতাটির সেই রাজনৈতিক বাস্তবতা উঠে আসছে নাঅন্তত আমার চোখে পড়েনি। মার্কস কোন গ্রন্থে জানি লিখেছিলেন, ‘ব্যাঙে যদি ব্যাঙের কথা লিখত, তাহলে জুলজি হবে না।’ কথাটি আমি বললাম আসলে যেকারণে: মানুষ যখন বাস্তবতার প্রত্যক্ষদর্শী হয়, তখন তার পক্ষে এবাস্তবতা হয়ে যায় কল্পনার অধিক। অথচ সাহিত্যের জন্য বাস্তবতার যত না প্রয়োজন, কল্পনার প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। পাঠক ক্ষমা করবেন। এক্ষেত্রে আমি আমার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের লোভ সামলাতে পারলাম না। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আমার অগ্রজপ্রতিম এক মারমা বন্ধু। তার মুখেই শোনা। ১৯৮০ সালে মার্চের প্রথম দিকে বরকল থানার শুভলং বাজার এলাকায় মেজর মহসিনের নেতৃত্বাধীন ২২ সদস্যের সামরিক পেট্রোল দল শান্তিবাহিনীর আক্রমণে নিহত হয়। ঐ হামলার প্রতিশোধ হিশেবে ২৫ মার্চ কাউখালি বাজারে মেজর কামালের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা মন্দির নির্মাণ ও আইনশৃঙ্খলার নাম করে ডেকে এনে ২০০ জন আদিবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। গুলি খাওয়ার পরও যেক’জন আদিবাসী বেঁচে ছিল, পরে তাদেরকে কুপিয়ে মারা হয়। এই ঘটনায় আমার আদিবাসী বন্ধু হারিয়েছে বেশ ক’জন নিকটআত্মীয়কে। তার মুখে এঘটনার বিবরণ শুনে অমি বারবার শিউরে উঠলেও সে ছিল নির্লিপ্ত, যেন ঘটনার আকস্মিকতায় সে খেই হারিয়ে ফেলেছে। হ্যাঁ, আদিবাসীরা আসলে এক ধরনের ঘোরের মধ্যেই আছে। আর যত দিন না এই ঘোর কাটছে, ততদিন আমরা ধরতে পারি, ইংল্যান্ডবাসী কবি আয়ারল্যান্ডের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থক ইয়েটসের মতোই আদিবাসীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটকে সাহিত্যে ধারণ করতে পারা একমাত্র কবি মাতিয়ার রাফয়েল।

তো, রাফায়েলের কবিতায় আমরা যেধর্মান্তরিত হওয়া যুবককে দেখছি, পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের ধর্মান্তরিত হবার মতোই, এখানে ধর্ম পরিবর্তনের পিছনে কোনো চিন্তাগত পরিবর্তন কাজ করেনি। অমর ওমর হয়েছে তার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তার জন্য। বিষয়টা রাফায়েলের কবিতায় উঠে এসেছে যেভাবে:

ছেলে আমার অমর, বহুদিন আগে নরবাণিজ্যে গিয়া ধর্মান্তরিত হৈয়া গিয়া ফিরিয়া আসে নাই আর এ মাতৃকোলে কোনদিন!

কবিতার এই দু’লাইন পাঠ করার সঙ্গেসঙ্গে মনে পড়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী বিখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মযাজক ও বুদ্ধিজীবী জেসমণ্ড টুটুর একটি বিখ্যাত উক্তি (পাঠস্মৃতি থেকে উদ্ধৃত): ‘শেতাঙ্গরা যখন আমাদের দেশে এল, তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের কাছে ছিল জমি। এখন আমাদের হাতে বাইবেল, তাদের কাছে জমি।’ আমাদের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এই উক্তিটি প্রযোজ্য, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে আমাদের দেশের আদিবাসীরা যেমন স্বভূমি থেকে উচ্ছিন্ন হয়েছে, তেমনি মিশনারিদের তৎপরতায় হারিয়েছে নিজস্ব ধর্মসমাজ ও সংস্কৃতি। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে পুঁজি করেই মিশনারিরা এদেশে আদিবাসীদের মধ্যে তাদের তৎপরতা শুরু করেছিল। তাদের হাতে রুটি তুলে দিয়ে কেড়ে নিয়েছে তাদের নিজস্ব ধর্মসংস্কৃতি। ধারণা করছি, রাফায়েলের কবিতায় অমরও এমন কোনো মিশনারি অপতৎপরতার শিকার হয়ে তার ধর্মসংস্কৃতি হারিয়েছে, যার জন্য বৃদ্ধা মায়ের মর্মস্পর্শী আকুতি। রাফায়েলের কবিতার ভাষায়:

গ্রামবৃদ্ধার স্মৃতি প্রবাহে তাহেই কী দীর্ঘশ্বাসে মৃদু মৃদু ধাক্কা খাইতে খাইতে আবার সরিয়া সরিয়া পড়িয়া যায়।

স্মৃতিতে প্রিয় পুত্রের মুখ ঝাপসা হয়ে এলেও হৃদয়ে পুত্রশোক এখনও স্থির। রাফায়েল তাঁর কবিতা নির্মাণে এই দু’টি পঙ্ক্তিতে শব্দের এমন গাঁথুনি দিয়েছেন, মনে হল, এই শোক ‘পোঁদশ্রেণীস্থা’ গ্রামবৃদ্ধার নয়, এই শোক কবি নিজেই ধারণ করছেন। কারণ একজন কবির চেয়ে বেশি সংবেদনশীল মানুষ কারা হতে পারে! এখানেই একজন সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টির মহত্ব। শক্তিমান শিল্পীই শুধু পারেন সামগ্রিক অনুভূতিটাকে নিজস্ব অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করতে। পরের পঙ্ক্তিতে যেটা আরও প্রবলভাবে ধরা পড়ে:

তখনই মাত্র লুটিয়া প’ড়ে স্মৃতিতে আবার কী যে মিহি টানে সেই ওঁ, ওঙ্কার ধ্বনিপর : ‘ওঁমর, মর’

প্রসবযাতনার ওঙ্কারধ্বনি এবং পুত্র হারানোর শোকের ধ্বনিএই দুই ধ্বনির কেমন অপূর্ব মিলন ঘটিয়ে দিলেন! শুধু এই একটি ক্ষমতা বিবেচনা করেই রাফায়েলকে নব্বইয়ের বাকি কবিদের থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। তো, আবার কবিতায় ফিরে আসা যাক।

তাহারই ধারাবাহিকতায় এক বর্ষাদিবস চোখে চষিয়া গেল চকিতে আমার, এক পঞ্চাশীতিপরায়ণা প্রায় ধনুকায় ধনুকায় গ্রামবৃদ্ধাবাছিয়া বাছিয়া কচু কাটিতেছে।

পাঠক, আমরা এই দু’পঙ্ক্তির ধারাবাহিকতায় পরের দু’পঙ্ক্তির দৃশ্যকাব্য লক্ষ করি:

আর ধ্বনিত হৈতেছে কণ্ঠ হৈতে, তাহারই যেন কোন অর্ধস্বর ভাঙিয়া, ‘ওঁকচু। অঁমর, ওঁমর’

এ কোন দৃশ্য কল্পনায় ভেসে উঠল! গ্রামবৃদ্ধার পুত্রশোকের নীল বিষে যাকে ছোবল মারার কথা, তার কাছে গ্রামবৃদ্ধার অবস্থা কীরকম?

পোঁদবৃদ্ধাটি যারপরনাই লজ্জাপর কৈল, বিদেশী বাবু, মুই ত কেউরে কোন শোধে এইসা অভিসম্পাৎ করিচ্চি না!

রাফায়েলের দৃষ্টিতে এটাই বুঝি সমাজের শাশ্বত নিয়ম! ‘পোঁদশ্রেণীস্থা’ বৃদ্ধাদের ক্ষোভ কি সবসময় আত্মদ্রোহের মধ্যে থাকে? সেটা কি কখনও বিদ্রোহে রূপ নেয় না? এখানেই রাফায়েলের রাজনৈতিক চেতনার সীমাবদ্ধতা; কবিতার পূর্বাংশ পড়ে রাফায়েলের সামাজিক দায়ের যেআভাস পেলাম, এই অংশে এসে সেই দায় কেমন যেন বিভ্রান্তি তৈরি করছেকচু কাটতে গিয়ে বিদেশি বাবুর কাছে বিনয়ের সাথে কৈফিয়ত! ‘পোঁদশ্রেণীস্থা’ বৃদ্ধারা শুধু কচুই কাটে না, কখনওকখনও মানুষের মাথাও কাটে! তো, এই ধারাবাহিকতায় কবিতার একেবারে শেষের দিকে নজর দেওয়া যাক।

ছেলে আমার অমর, বহুদিন আগে নরবাণিজ্যে গিয়া ধর্মান্তরিত হৈয়া গিয়া ফিরিয়া আসে নাই আর এ মাতৃকোলে কোনদিন!

কী নতুন নাম না কি হৈয়াছিল তাহার, অমর হৈতে ওমর, বাবুজি গা’, মুই ত তাহাই ধৈরা ডাকিচ্চি,

অঁমর, ওঁমর’….

রাফায়েল তাঁর দীর্ঘ কবিতায় শেষাংশে ইঙ্গিতময়তা কিংবা কাব্যময়তার প্রযোজন অনুভব করেননি। ওই যে বলেছি, রাজনৈতিক চেতনায় ভ্রান্তি। ছেলে নরবাণিজ্য করতে গিয়ে অমর থেকে ওমর হয়ে গেছে, কিন্তু সমাজবাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। অমররা সাধারণভাবে কেউ ওমর হচ্ছে না। ‘মাইকেল রোজারিও’ ইত্যাদি হচ্ছে। কবি অমরকে ওমর করেছেন। মোদ্দাকথা, তাঁর সামনে দৃশ্যমান শাসকশ্রেণি হচ্ছে মুসলমান, তাই কবি কলমের খোঁচায় অমরকে ওমর বানিয়েছেন। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রাফায়েলের ক্ষোভ জমা পড়েছে রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু নাগরিকের ধর্মবিশ্বাসে উপর। এখানেই আমার মনে হল, রাজনৈতিক চেতনায় ভ্রান্তি। আবার হতে পারে, কবির নয়, আমারই হয়তো ভুল; কারণ, কবিতা সবসময় এক রহস্যময় শিল্প, যেখানে একএকটি যতিচিহ্ন একএকটি বিশাল অর্থের দায় বহন করে। তাই বলছি, এই অমর আসলে কোনো ধর্মের নয়, এক রাজনৈতিক চেতনার প্রতিনিধিও হতে পারে। মাতিয়ার রাফায়েল তাঁর সৃষ্টির সহজাত ক্ষমতা দিয়ে সমাজের যেযাতনা চিহ্নিত করেছেন, এতে তাঁর পাঠকের হৃদয়ে নিঃসন্দেহে কম্পন তৈরি হবেই, তবে এই আত্মকম্পনের ক্ষোভ বিদ্রোহে রূপ নেওয়ার জন্য যেসুচিন্তিত রাজনৈতিক চেতনা দরকার, ‘মর ওমর…’ কবিতায় সেটাই বড় ঘাটতি। অবশ্য এক্ষেত্রে কবি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলতে পারেন, শিল্পের দায় রাজনীতির কাছে নয়, শিল্পের কাছে, তা না হলে বালজাক কেন হতে যাবেন মার্কসের প্রিয় কবি বা আধ্যাত্মিক চেতনায় বিশ্বাসী টলস্টয় কেন হবেন লেনিনের প্রিয় লেখক? তবু বলছি, কবি কি কেবল বোদ্ধা পণ্ডিতদের জন্যই কবিতা লেখেন? এমন শক্তিশালী কবিতা কি সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে লেখা যায় না? প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে কবি মাতিয়ার রাফায়েলের বিভিন্ন সময়ে যেকথোপকথন হয়েছে, তা থেকে কিঞ্চিৎ স্মৃতিচারণ করে আমার লেখা শেষ করছি:

আপনি এত কঠিন করে লেখেন কেন?

সহজে পাঠকের কাছে ধরা দিতে চাই না বলে।

আপনার কবিতা একবারে পাঠ করে বোঝা খুব মুশকিল।

তাহলে দ্বিতীয়বার পড়ো।

দ্বিতীয়বারও সব পাঠক বুঝে উঠতে পারবে না।

তাহলে বারবার পড়ো।

হ্যাঁ, মাতিয়ার রাফায়েলের অনেক কবিতাই বারবার পড়ার দাবি রাখে।।

মতামত জানান...

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.