লিখেছেন: অজয় রায়
লাতিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বাধীন সরকারকে ফেলে দেওয়ার তৎপরতা চলছে। স্পষ্টতই, সেদেশের শাসকশ্রেণীর সিংহভাগসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার দোসররা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়িয়েছে। কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। ভেনেজুয়েলায় রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম তেল ভাণ্ডার। যা পুরোপুরি কব্জা করতে চায় তারা।
গত জানুয়ারিতে মার্কিন সরকার ভেনেজুয়েলায় বিরোধী দলীয় নেতা ও স্বঘোষিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট’ হুয়ান গুয়াইদোকে স্বীকৃতি দেয়। তার পরপরই মাদুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সবরকম কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেন। গত ৩০ এপ্রিল সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট গুয়াইদোর অভ্যুত্থান চেষ্টা ব্যর্থ হয়।[১] ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারের প্রতি অনুগত ছিল। অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য পরবর্তীকালে জাতীয় পরিষদের কিছু দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদকে গ্রেফতার করে মাদুরো সরকার। অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় জড়িত কয়েকজন সেনা সদস্যকেও বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যেই ভেনেজুয়েলায় সামরিক হস্তক্ষেপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে ওয়াশিংটন। তবে কিউবা, রাশিয়া, চীন ও অন্যান্য আরও কয়েকটি দেশ মাদুরো সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।
স্পষ্টতই, ভেনেজুয়েলায় সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। খাদ্যাভাব ও ওষুধের ঘাটতি চলছে। ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া বেআইনী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার দরুন ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৪০,০০০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন সেদেশে।[২]
ভেনেজুয়েলার রাজস্বের প্রধান উৎস তেল ক্ষেত্র। দেশটির তেল রপ্তানির উপর অবৈধ অবরোধ আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। আর ভেনেজুয়েলার সরকারি তেল সংস্থা পিডিভিএসএ’র ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদ চুরি করেছে।[৩] দেশটির জাতীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার পরিকাঠামোতেও অন্তর্ঘাত ঘটানো হয়েছে।
লক্ষণীয় যেটা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে ভেনেজুয়েলায় চরম দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে মদদ দিচ্ছে। বিরোধীপক্ষকে অর্থ ও প্রশিক্ষণ জোগাচ্ছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স সূত্রে খবর, ভেনেজুয়েলার সরকার ফেলতে একটি ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী মোতায়েনের চেষ্টাও চলছে। আর এ সবকিছুই করা হচ্ছে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’ রক্ষার অজুহাতে। ভেনেজুয়েলার সরকার ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা অবশ্য নরওয়েতে ‘আলোচনায়’ বসেছিলেন। তবে কোনো রকমের ‘সমঝোতা বা চুক্তি’ ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়েছে গত ৩০ মে।[৪]
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘মুক্ত বাজারে’ ধস নামার ফলে লাতিন আমেরিকার ‘নয়া বামেরা’ সংকটে পড়েছে। সেখানকার মধ্য–বাম সরকারগুলোর অর্থনৈতিক নীতি বরাবরই কাঠামোগত দুর্বলতা কাটানোর বিষয়টি এড়িয়ে চলেছে। আর নয়া–উদারবাদী নীতির সঙ্গে আপোষ করেছে। তাদের আমলে শাসকশ্রেণীর অর্থনৈতিক কর্তৃত্বও অক্ষুন্ন থেকেছে। ভেনেজুয়েলার জাতীয়তাবাদী সোস্যাল ডেমোক্র্যাটিক সরকারও একই পথের পথিক। তবে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুগো শ্যাভেজের নেতৃত্বে সীমিত পরিসরে হলেও কিছু জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় অবশ্য সেই তথাকথিত ‘বলিভারিয়ান প্রক্রিয়া’ বড় রকমের হোঁচট খেয়েছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির আরও অধোগতি হচ্ছে। সেইসঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। মাদুরো সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
এর মধ্যেই ভেনেজুয়েলার মেহনতি জনগণ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরব হচ্ছেন। আর লাতিন আমেরিকার কিছু দেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের একাংশও দেশটির প্রতি সংহতি জানিয়েছে।।
৩১/০৫/২০১৯
তথ্যসূত্র
[১] “Venezuelan gov’t thwarts attempted coup”, 1 May 2019, Xinhua
[২] “Report: U.S. Sanctions Have Killed 40,000 in Venezuela Since 2017”, 26 April, 2019, Democracy Now!
[৩] “China Affirms Support for Venezuela, Condemns Sanctions”, 29 January 2019, Telesur