লিখেছেন: হাসিবুর রহমান
১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শামসুল হক শিক্ষা কমিশন সরকারের কাছে তার রিপোর্ট পেশের পর থেকেই শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য, শিক্ষার সংকট ইত্যাদি বিষয়ে গত দুই বছরে কিছু লেখালেখি হয়েছে। যদিও এই লেখালেখি পরিমাণগত ও গুণগত মানের দিক থেকে যথেষ্ট নয়।
শিক্ষানীতি নিয়ে একটি উল্লেখ্যযোগ্য প্রকাশনা হলো বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান এর শিক্ষানীতি ও শিক্ষা সংকট প্রসঙ্গে পুস্তিকাটি। গত বছরের জুলাই মাসে এই পুস্তিকাটি প্রকাশ করে বাসদ–এর ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট।
খালেকুজ্জামান বাসদ–এর আহ্বায়ক, তারা দাবি করেন যে বাসদ–ই এদেশের একমাত্র প্রকৃত বিপ্লবী রাজনৈতিক দল। সে কারণেই এই বিপ্লবী রাজনৈতিক দলটির শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী পর্যালোচনার দরকার হয়ে পড়েছিল। এই প্রবন্ধটিতে সেটাই করা হয়েছে।
শিক্ষার অধিকার; অধিকারের সীমানা
আমরা শুরু করতে পারি শিক্ষার অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে। এ কথাটা বেশ শোনা যায়, ‘শিক্ষা আমার অধিকার, এ অধিকার সবার চাই’। কিন্তু এ অধিকারের মানে কি? এর কি কোন সীমা রয়েছে না তা সীমাহীন? সীমাবদ্ধ হলে তা কিসের দ্বারা নির্ধারিত হয়?
গোথা’য় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে জার্মান শ্রমিক পার্টি তাদের কর্মসূচিতে ঘোষণা করেছিল: “শ্রমের মুক্তি এই দাবিই করে যে শ্রমের উপায় সমূহকে সমাজের সাধারণ সম্পত্তিতে উন্নীত করা হোক এবং সমগ্র শ্রমের সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে শ্রমের ফলাফলকে ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টন করা হোক।”১
এ কর্মসূচির সমালোচনা করতে গিয়ে মার্কস অধিকার প্রসঙ্গে বলেন: “অধিকার কখনোই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো এবং তদ্বারা নির্ধারিত সাংস্কৃতিক বিকাশকে অতিক্রম করে যেতে পারে না।”
শ্রমের ফলাফলকে ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টনের প্রশ্নে বলেন: “ভোগের উপকরণ সমূহের যে বন্টনই হোক না কেন তা আসলে উৎপাদনের শর্ত সমূহের বন্টনেরই ফলাফল মাত্র। শেষের এই বন্টনটি আবার খোদ উৎপাদন সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য সূচক। উদাহরণ স্বরূপ, পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিটা হলো এই যে, উৎপাদনের বস্তুগত শর্তাবলী পুঁজি ও ভূমি সম্পত্তির আকারে অ–শ্রমিকদের হাতে রয়েছে, আর জনগণের মালিকানায় কেবল উৎপাদনের ব্যক্তিগত শর্তটি, শ্রমশক্তি। উৎপাদন উপকরণ সমূহের এই যদি হয় বন্টন, তাহলে ভোগের উপকরণ সমূহের বন্টনও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বর্তমানকার চেহারা নেবে। …….. বন্টনকে উৎপাদন সম্পর্ক থেকে স্বাধীন হিসেবে বিবেচনা করা এবং সমাজতন্ত্রকে কেবল মূলতঃ বন্টনের ব্যাপার বলে উপস্থাপিত করবার ধরনটি বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে স্থূল সমাজতন্ত্রীরা (এবং তাদের কাছ থেকে গণতন্ত্রীদের একাংশ) ।”২
মার্কস অন্যত্র লিখেছেন: “বন্টন কাঠামো পুরোপুরিভাবেই উৎপাদন কাঠামো দ্বারা নির্ধারিত হয়। বন্টন নিজেই উৎপাদনের ফলাফল, কেবল আধেয় হিসেবেই নয়, যেহেতু শুধুমাত্র উৎপাদনের ফলাফলকেই বন্টন করা চলে, একই সাথে বিন্যাসের দিক থেকেও, যেহেতু উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানুষের অংশগ্রহণের নির্দিষ্ট ধরনটি বন্টনের নির্দিষ্ট বিন্যাস নির্ধারণ করে, বিন্যাস অর্থাৎ যেভাবে তারা বন্টনের অংশীদার হয়।”৩
মার্কস–এর বক্তব্য খুবই পরিষ্কার: ১. যে কোন অধিকারেরই সীমা আছে, যা কখনো সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে অতিক্রম করে যেতে পারে না। ২. উৎপাদন–সম্পর্ক নির্ধারণ করে বন্টন ও বন্টনের পদ্ধতি। উৎপাদন–সম্পর্কের কোন প্রান্তে কে আছে তার দ্বারা তার ভোগের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। ৩. বন্টনকে উৎপাদন সম্পর্ক থেকে পৃথকভাবে বিবেচনা করার কোনই সুযোগ নেই।
আ্যন্টি–ডুরিং–এ এঙ্গেলস বন্টন প্রসঙ্গে বলছেন: “একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সমাজের উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতি, এবং যে ঐতিহাসিক শর্তাবলী ঐ সমাজের জন্মদান করেছে, তা একই সঙ্গে সমাজের উৎপাদিত দ্রব্য বিতরণের পদ্ধতিও নির্ধারন করে।”
“বিতরণ নিছক উৎপাদন ও বিনিময়ের নিষ্ক্রিয় ফল নয়—এক পর্যায়ে এটিও অন্য দুটোর উপর প্রভাব বিস্তার করে। প্রতিটি নতুন উৎপাদন পদ্ধতি বা বিনিময় ধরন শুধুমাত্র পুরনো উৎপাদন পদ্ধতি বা বিনিময় ধরন দ্বারাই বাধাগ্রস্থ হয় না, পুরনো বিতরণ পদ্ধতি দ্বারাও বাধাগ্রস্থ হয়; নিজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিতরণ পদ্ধতি স্থাপন করতে তাকে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে যেতে হয়।”৪
অর্থাৎ বিতরণ পদ্ধতি যে কেবল উৎপাদন পদ্ধতি ও নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক শর্তাবলী দ্বারা নিয়ন্ত্রিতই হয় তাই নয়, একটি নতুন উৎপাদন পদ্ধতিকে নিজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বিতরণ পদ্ধতি স্থাপন করতে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে যেতে হয়। পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সাম্যবাদী সমাজে উত্তরণের কালেও বন্টন পদ্ধতিতে কিভাবে দীর্ঘকাল পুরনো সমাজের চিহ্ন রয়ে যায় মার্কস গোথা কর্মসূচির সমালোচনায় তা যথেষ্ট বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে বাধ্যতামূলক শিক্ষা অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় খরচে শিক্ষা কোথাও প্রাথমিক কোথাও মাধ্যমিক পর্যন্ত রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদের অধীনে শ্রমজীবী জনগণের শিক্ষার অধিকারের সীমানাটা কি তা পরিমাপ করা প্রয়োজন। এ জন্য আমাদের দেখতে হবে কোন ঐতিহাসিক শর্তাবলীর অধীনে, উৎপাদন পদ্ধতির কোন প্রয়োজন থেকে পুঁজিবাদ শ্রমজীবীদের শিক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
“উৎপাদন উপকরণের অবিরাম বিপ্লবী বদল না এনে, এবং তাতে করে উৎপাদন–সম্পর্ক ও সেই সঙ্গে সমগ্র সমাজ–সম্পর্কে বিপ্লবী বদল না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী বাঁচতে পারে না। অপরদিকে অতীতের শিল্পজীবী সকল শ্রেণীর বেঁচে থাকার প্রথম শর্তই ছিল সাবেকি উৎপাদন–পদ্ধতির অপরিবর্তিত রূপটি বজায় রাখা। আগেকার সকল যুগ থেকে বুর্জোয়া যুগের বৈশিষ্টই হল উৎপাদনে অবিরাম বিপ্লবী পরিবর্তন, সমস্ত সামাজিক অবস্থায় অনবরত নড়চড়, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা এবং উত্তেজনা।”৫
“কিন্তু একদিকে কাজের প্রকারান্তরের ঘটনা প্রকৃতির নিয়মের অদম্য শক্তির মতো চেপে এসে হাজির হয়, স্বভাবের অন্ধ শক্তির মতো ধ্বংস নিয়ে আসে, আর সর্বক্ষেত্রে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, তেমনই অন্যদিকে এই সব দারুন বিপৎপাতের মাধ্যমে একটা বিষয়কে উৎপাদনের আবশ্যিক নিয়ম হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করে। সেটা হচ্ছে ঐ কাজের প্রকারান্তর ঘটা, সেই প্রকারান্তরের ফলে বিভিন্ন প্রকার কাজের জন্য শ্রমিকের যোগ্যতা এবং বিভিন্ন প্রকারের কাজের জন্য সর্বাধিক সম্ভব বিকাশ। উৎপাদন পদ্ধতির এই নিয়ম রীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলাটা সমাজের জন্য মরণ বাঁচনের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।”৬
অর্থাৎ, উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে অনবরত পরিবর্তন ঘটানো ছাড়া, উৎপাদন–শক্তির ক্রমাগত বিকাশ ঘটানো ছাড়া পুঁজিবাদ টিকে থাকতে অগ্রসর হতে পারে না। সামন্ত সমাজে পুঁজিবাদী উৎপাদনের আবির্ভাব ঘটার কয়েক শত বছর পর, আধুনিক শিল্পের সূচনার পরই তা গোটা সমাজে প্রাধান্য বিস্তারে সক্ষম হয়। শিল্পের এই বিস্তার আবার বৈজ্ঞানিক গবেষণা–আবিস্কার ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত। পুঁজিবাদী উৎপাদনের বিকাশের সাথে তাই বৈজ্ঞানিক শিক্ষা–গবেষণা–আবিস্কারের গভীর সম্পর্ক। এ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে শিক্ষার বিস্তার ছাড়া উপায় কি?
উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে শ্রমিকদেরও দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে হয়। আধুনিক যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে গেলে শ্রমিকদের জন্য তাই ন্যূনতম শিক্ষার ব্যবস্থা করতেই হয়। কেননা ‘উৎপাদকের জন্য নতুন ধরনের দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার সহায়ক শিক্ষা ও ব্যবস্থার যোগান দিতে না পারলে সে সমাজ টিকবে না। এই জন্যই মার্কস বলেছেন, এ তার মরণ বাঁচনের প্রশ্ন।’৭ প্রধানত এ কারণেই পুঁজিবাদের অধীনে এক পর্যায়ে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়। পরবর্তীতে যা বহু দেশে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার এর আরো কিছু সুবিধা রয়েছে যেটি বুর্জোয়ারা পরে আবিস্কার করে। ব্রীগ ও জর্ডান তাঁদের Economic History of England এ বিষয়ে লিখেছেন: “The function was to provide the workers with a discipline by consent. In the 19th century the employers relied on discipline by fear…fear of unemployment etc..but in industry discipline by fear is far from satisfactory. Education can help to create another form of discipline. It develops a capacity for looking at both sides of a question and without such discipline cooperation between two sides of industry is impossible. In this respect education works very slowly but the seeds of a movement that is rapidly developing today were planted in the first stages of working class education in the 19th century.”৮
এ উপমহাদেশে শিক্ষার, এবং প্রধানত প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তারে ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকদের ভূমিকাই ছিলো মুখ্য। এর প্রয়োজনটা তারা ভালই বুঝেছিলো। “ইংরেজ আমলে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণভাবে বলা হয় যে, তা শুধু কেরানী সৃষ্টির জন্য তৈরী হয়েছিল। কথাটা আংশিকভাবে সত্য। কারণ ভারতবর্ষে ইংরেজ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় শুধু কেরানী সৃষ্টিরই প্রয়োজন ছিলো না। প্রয়োজন ছিলো মূলতঃ এমন একটা শ্রেণী সৃষ্টি যারা পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়ে ভারতীয় জনগণ থেকে নিজেদের তফাৎ করবে এবং সাংস্কৃতিক, আধিমানসিক ও জীবিকার দিক দিয়ে তৎকালীন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল থাকবে। এবং ইংরেজ শাসনের উপর তাদের এই নির্ভরশীলতার উপরই গড়ে উঠবে ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনের সামাজিক ভিত্তি।”৯
এই সব আলোচনা থেকেই আমরা দেখতে পাই শিক্ষা বিস্তারের প্রশ্নটি উৎপাদন–সম্পর্কের সাথে যুক্ত। তাই যে আর্থ–সামাজিক ভিত্তিভূমির উপর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে সে সম্পর্কে সচেতন থেকেই আমাদের শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি হাজির করতে হয়।
কমিউনিস্টরা তাই যখন কোন কিছু দাবি করেন বা কোন কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তখন অধিকারের সীমানা, বন্টনের ভিত্তি সম্পর্কে সচেতন থেকেই তা করেন। কর্মসূচি গ্রহণের সময় এ বিষয়ে সচেতন থাকার মানে এই নয় যে, বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিকার সম্পর্কিত সীমানা গ্রহণ করা হলো বা সেটিকেই প্রতিষ্ঠিত করা হলো। বরং এর দ্বারা এটাই বুঝায় যে কমিউনিস্টরা নির্দিষ্ট সমাজের বিশেষ ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে সচেতন, কোন ধরনের অবাস্তব, অনৈতিহাসিক চিন্তা বা ভাবালুতা দ্বারা আক্রান্ত নন।
আরেকটি বিষয়, বুর্জোয়া সমাজে শিক্ষা নিজেই সম্পত্তি, বুর্জোয়া সম্পত্তি, রূপে আবির্ভূত হয়েছে। বিয়ে, চাকুরীসহ নানাবিধ অর্থনৈতিক–সামাজিক–সাংস্কৃতিক সম্পর্ক–অবস্থান নির্ধারণে শিক্ষা সম্পত্তির অপরাপর রূপের মতই স্বীয় ভূমিকা পালন করে। বুর্জোয়া সম্পত্তির এই নির্দিষ্ট রূপটির উপর সমাজের সকল শ্রেণীর সমান অধিকার থাকবে, শিক্ষার অনুভূমিক ও উলম্ব বিস্তার গোটা সমাজ জুড়ে একই রকম থাকবে, এটা ভাবা অলীক কল্পনামাত্র।
উপরের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর আমরা দেখব শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে খালেকুজ্জামান–এর বক্তব্য কি।
এ সম্পর্কে খালেকুজ্জামানের বক্তব্য ঘণীভূত হয়েছে কয়েকটি দাবি–কর্মসূচিতে। ‘স্নাতক পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা’, ‘উচ্চ শিক্ষা হবে সবার জন্য অবারিত’, ‘প্রত্যেক জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে’।
তিনি বলছেন: ‘শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে’। কিন্তু এই দায়িত্ব শুধু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত নয় এটা হতে হবে স্নাতক পর্যন্ত। কারণ ‘…আজ চাই সমন্বিত শিক্ষা। অর্থাৎ সকলের জন্য সাধারণ শিক্ষার স্তরকে এমন স্তরে উন্নীত করতে চাই যাতে একজন মানুষ ইচ্ছা করলেই জ্ঞান জগতের যে কোন পথে প্রবেশ করতে পারে। ….এ ভাবেই মুক্তবুদ্ধির বাধাহীন চর্চা তথা বুদ্ধির রাজ্যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।’
‘আমাদের দেশে সমন্বিত শিক্ষার এ স্তর হওয়া বাঞ্চনীয় স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত। বাধ্যতামূলক শিক্ষাও সেজন্য স্নাতক পর্যন্ত করতে হবে। ’ (পৃ. ২৫)
আবারো আমাদের মার্কস–এর গোথা কর্মসূচির সমালোচনা–তে ফিরে যেতে হচ্ছে। জার্মান শ্রমিক পার্টি তাদের গোথা কর্মসূচিতে ঘোষণা করেছিল: “রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক ভিত্তি হিসেবে জার্মান শ্রমিক পার্টি দাবি করে: ১. রাষ্ট্র কর্তৃক সার্বজনীন ও সমান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক স্কুল গমন। বিনা বেতনে শিক্ষা।”
পার্টির এই কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করেন মার্কস: “সমান প্রাথমিক শিক্ষা? কোন ধারনা থেকে এই কথাগুলো লিখা হয়েছে? বর্তমান সমাজে (এবং একমাত্র বর্তমান সমাজ নিয়েই আলোচনা চলছে) সকল শ্রেণীর জন্য সমান শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে এ কথাই কি বিশ্বাস করা হচ্ছে? নাকি এই দাবি করা হচ্ছে যে, কেবল সেই সামান্য শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ, যা শুধু মজুরী শ্রমিক নয়, কৃষকদের অবস্থার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ, উপরের শ্রেণীগুলোকেও সেইখানে নেমে আসতে বাধ্য করতে হবে?”
“কিন্তু এত গণতান্ত্রিক বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও, সমগ্র কর্মসূচিটি আগাগোড়া কলঙ্কিত রাষ্ট্রের উপর লাসালীয় গোষ্ঠির দাসসুলভ বিশ্বাসের দ্বারা, বা, যা একই রকম খারাপ, অলৌকিকের প্রতি গণতান্ত্রিক বিশ্বাস দ্বারা, বরং বলা যেতে পারে এটি সমাজতন্ত্র থেকে সমান দুরবর্তী এই দুই অলৌকিক বিশ্বাসের মধ্যে এক আপোষ।”১০
মার্কসের সমালোচনার জায়গাটা হচ্ছে: বুর্জোয়াদের রাষ্ট্রে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা হতে পারে, কিন্তু এই শিক্ষা সকল শ্রেণীর জন্য সমান হতে পারে না। পাঠক্রম, ভৌত ও অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধাদি, শিক্ষার মান ইত্যাদি ক্ষেত্রে সকল শ্রেণীর জন্য শিক্ষার সমান ব্যবস্থা থাকতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে সমান শিক্ষার দাবি বাস্তবায়িত করতে গেলে উপরের শ্রেণীগুলোকে এমন এক প্রাথমিক শিক্ষার পর্যায়ে টেনে নামাতে বাধ্য করতে হবে যে শিক্ষা কেবল শ্রমিক ও কৃষকের জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। পার্টি কর্মসূচিতে সমান প্রাথমিক শিক্ষার এই দাবি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ও অন্ধবিশ্বাস স্থাপনের সামিল, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অলৌকিকত্বের উপর বিশ্বাস স্থাপনের সামিল বলে কঠোর সমালোচনা করেছেন মার্কস। মার্কস–এর অলোচান থেকে যে অনুসিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে তা হলো: উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে সকলের সমান প্রবেশাধিকার থাকতে পারে না।
খালেকুজ্জামান কিন্তু এসব সমালোচনাকে মোটেই বিবেচনার যোগ্য মনে করেন না। সকলের জন্য স্নাতক পর্যন্ত সমান শিক্ষার দাবি করতে গিয়ে তিনি শ্রেণীর প্রশ্ন এবং রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের প্রশ্ন বেমালুম চেপে গিয়েছেন। বলছেন এই কর্মসূচির দ্বারা বুদ্ধির রাজ্যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। বস্তুজগতে কোন পরিবর্তন ছাড়াই জ্ঞানের রাজ্যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র!
মার্কসের সমালোচনাতেই আমরা দেখেছি সকলের জন্য সমান শিক্ষার দাবিটিই আসলে রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্তিকর। কেননা শিক্ষা যে এখানে সবার জন্য সমান হতে পারে না এ প্রশ্নটিই তখন অনুপস্থিত হয়ে পড়ে; বৈষম্যই যে এই রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সেটা অনালোচিত থেকে যায়। ফলে শিক্ষা প্রশ্নের ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র উচ্ছেদের কর্মসূচির অনিবার্যতা ও যৌক্তিকতা আর প্রাণ পায় না। প্রাধান্যে চলে আসে বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেই সমস্যা সমাধানের প্রশ্ন, অর্থাৎ সংস্কারমূলক কর্মসূচি। এভাবেই সকলের জন্য সমান (একেবারে স্নাতক পর্যন্ত!) শিক্ষার দাবি জনগণকে সূক্ষ্মভাবে বিদ্যমান রাষ্ট্র উচ্ছেদের কর্মসূচি থেকে সরিয়ে এনে রাষ্ট্রের কাছে আবেদন নিবেদনের জন্য তৈরী করে। শেষ বিচারে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাটা অটুট রাখে, সরকারকে ঠিকমতো চাপ দিলে বা বিবেকবান সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব এমন ভাবনাটা পুনোরুৎপাদন করে চলে। এবং ঠিক একারণেই এমন কর্মসূচির কঠোর সমালোচনা করেছেন মার্কস, বলেছেন এ হলো রাষ্ট্রের উপর দাসসুলভ বিশ্বাস স্থাপন। সম্ভবত নিজের অজান্তেই রাষ্ট্রের উপর সেই দাসসুলভ বিশ্বাস স্থাপন (মাফ করবেন, কথাটা স্বয়ং মার্কস–এর) করে বসে আছেন খালেকুজ্জামান।
সমান শিক্ষার দাবিটা স্নাতক পর্যন্ত বিস্তৃত করেছেন খালেকুজ্জামান। কোন সময় এই দাবিটি করছেন তিনি? যখন তিনিই আমাদের জানাচ্ছেন, ‘দেশের ৮৭.৫% স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষার উপযোগী পাঠ উপকরণ নেই। ৮১.৫% স্কুলে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি নেই।’ ‘বর্তমানে আমাদের শিক্ষার মূল ধারাই হলো নিরক্ষরতা ও অশিক্ষার ধারা। কারণ শতকরা ৬৩ ভাগ লোকই রয়েছে নিরক্ষর।’ ‘উচ্চবিত্ত স্বচ্ছল পরিবারের জন্য কিন্ডারগার্টেন, ক্যাডেট কলেজ, ও লেভেল, এ লেভেল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ ইত্যাদি’ রয়েছে। ‘মধ্যবিত্ত–নিুবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের একাংশের জন্য সাধারণ শিক্ষা (যার মধ্যে আবার শতকরা ৯৫ ভাগের জন্য বেসরকারী ও ৫ ভাগের জন্য সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান)’। কিন্তু এসবই খালেকুজ্জামানের কাছে কিছু তথ্য মাত্র। তাঁর সামান্য এই তথ্য থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড়ো যে বৈষম্যর সন্ধান পাওয়া যায় সেটিকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, “শিক্ষা ক্ষেত্রে যত প্রকার বৈষম্য আছে তার মধ্যে সব থেকে বড়ো বৈষম্য হলো একদিকে দেশের সব থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত অতি অল্প সংখ্যকের উচ্চতম শিক্ষা এবং অন্যদিকে কোটি কোটি ছেলে মেয়ের নিরক্ষরতা অথবা নাম কে ওয়াস্তে প্রাথমিক শিক্ষা”।১১ শুধু ছেলে মেয়ে নয় বয়স্কদেরও আমাদের এই হিসেবের মধ্যে ধরতে হবে। আর এটা ঘটছে যখন এদেশে সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি জোরেশোরে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
শাসক শ্রেণীর ঘোষিত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা– অধিকারের এই গন্ডিতেই যখন জনগণ প্রবেশ করতে পারছেন না, তখন খালেকুজ্জামান হাজির করেছেন বাধ্যতামূলক স্নাতক শিক্ষার কর্মসূচি। কিন্তু শুধু এই পর্যন্তই তাঁর ঘোষিত কর্মসূচি নয়, তিনি দাবি করছেন সরকার জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করুক। এর পেছনে যুক্তিটা বড়ো অদ্ভুত, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়তে আসবে তারা তো শিক্ষার নিুস্তরগুলি পার হয়েই আসবে, সুতরাং জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করা মানেই সবার জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার দাবি করা। মনে হতে পারে অধিকারের গন্ডিটি এভাবে বাড়ানো গেলো। কিন্তু কার্যত এর দ্বারা যা হচ্ছে তা হলো, কোটি কোটি মানুষ যে প্রাথমিক শিক্ষাই পাচ্ছেন না, সেটা আড়ালে পড়ে যাওয়া। যে আড়াই–তিন লক্ষ ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করছে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তাদেরই একাংশ সেখানে পড়াশোনার সুযোগ পাবে, যে সুযোগ তারা এখন গ্রহণ করছে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলিতে। প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার তাই এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করে না। এ কর্মসূচির সাথে শ্রমজীবী জনগণ তাই কখনোই একাত্মতা বোধ করেন না। এ কর্মসূচি দ্বারা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে সরকার যে প্রতারণা করছে তা উন্মোচিত হয় না।
বর্তমান সময়ে আমাদের প্রয়োজন সরকারকে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধ্য করা। শ্রমিক–গ্রামীণ মজুর–কৃষক ও ছাত্র সংগঠন প্রত্যেকেই এই দাবি তুলতে পারেন। এই দাবির ভিত্তিতে শ্রমজীবী জনগণের সাথে ছাত্রদের সম্পর্ক স্থাপন এবং উভয়ের যৌথ সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভব। এই যৌথ সংগ্রাম কালে এদেশে শ্রেণী সংগ্রামকে বিকশিত করতে সহায়তা করবে। বর্তমান সময়ে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছাত্রদের শ্রমজীবী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। এটা নিছক শিক্ষার কর্মসূচি নয়; শ্রেণী সংগ্রামের বিরুদ্ধে, বিপ্লবের বিরুদ্ধে এটা এক চক্রান্তমূলক রাজনৈতিক কর্মসূচি। কমিউনিস্টদের কর্তব্য এ কর্মসূচির রাজনৈতিক চেহারাটা উন্মোচিত করা।
অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। এ আলোচনা আমরা শেষ করবো মার্কস–এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে: “কমিউনিস্ট সমাজের উচ্চতর পর্যায়ে, শ্রম–বিভাগের নিকট মানুষের দাসসুলভ অধীনতা নিশ্চিহ্ন হবার পর; যখন সেই সাথে লোপ পাবে মানসিক ও কায়িক শ্রমের বৈপরীত্য; যখন শ্রম কেবল বেঁচে থাকার অবলম্বন না হয়ে পরিণত হবে জীবনের প্রাথমিক চাহিদায়; যখন ব্যক্তির সর্বাঙ্গীন বিকাশের সাথে সাথে উৎপাদন শক্তিগুলিও বেড়ে উঠবে এবং সামাজিক সম্পদের সব উৎস পূর্ণ বেগে উৎসারিত হবে,- কেবল তখনই সম্পূর্ণরূপে বুর্জোয়া অধিকারের সঙ্কীর্ণ দিগন্ত অতিক্রম করা সম্ভব হবে এবং সমাজ তার পতাকায় লিখে নিতে পারবে: ‘প্রত্যেকে দেবে তার সাধ্য মতো, প্রত্যেকে পাবে চাহিদা অনুযায়ী!”১২ কিন্তু সে কেবল কমিউনিস্ট সমাজেই।
শিক্ষা ও নৈতিকতা; নৈতিকতার শ্রেণী ভিত্তি
এবারে আমরা নৈতিকতা প্রসঙ্গে খালেকুজ্জামানের বক্তব্য পর্যালোচনা করব।
‘শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকে ধ¦সিয়ে দিচ্ছে’ এই শিরোনামের অংশটির শুরুতেই খালেকুজ্জামান বলছেন: ‘শিক্ষা মনুষ্যত্বের বাহন। সেজন্যই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করা চলে না। ক্রেতা–বিক্রেতা সম্পর্কে দর–দাম যাচাই এর প্রেক্ষিতে আর যাই হোক শিক্ষা হয় না। বৈষয়িক ও ভাবগত উৎপাদন সংগ্রামের মধ্যে প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে নিয়োজিত বিশ্বব্যাপী সকল মানুষের ভূমিকা এক হয় না, ব্যক্তিগত অবদান–অর্জনেরও তারতম্য ঘটে। কিন্তু তা যখন মানুষের কাছে জ্ঞান রূপে স্বীকৃতি লাভ করে এবং জ্ঞান ভান্ডারে জমা হয়, তখনই তা মানব জাতির সম্পদে পরিণত হয়।’ (পৃ. ৫৮)
‘মাদ্রাসা শিক্ষা নৈতিক শিক্ষাকে ধারণ করে না’ এই শিরোনামে খালেকুজ্জামান বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার পক্ষে প্রধান যে যুক্তিটা দেওয়া হয় সেটা হচ্ছে মাদ্রাসা ধর্ম শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দেয়। সমাজের সর্বস্তরে বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটে চলেছে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে তা দূর করার সম্ভাবনার কথাও বলা হয়ে থাকে।
‘বাস্তবে এ দাবির কোন প্রাসঙ্গিকতা কিংবা যুক্তি নেই। কারণ বর্তমান পুঁজিবাদী অবক্ষয়ী আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থাই যে নীতি, নৈতিকতা মূল্যবোধসমূহকে সংহার করে চলেছে এ ঐতিহাসিক ও বাস্তব সত্যকে উপেক্ষা করে যতই ধর্ম শিক্ষার কথা বলা হোক না কেন তা বাস্তবে নীতিহীনতার পথেই নিয়ে যেতে বাধ্য।’ (পৃ. ৪৭)
খালেকুজ্জামানের এ সব বক্তব্য ও উদ্বেগ থেকে আমরা যে সব সিদ্ধান্ত টানতে পারি তা হলো: ১. শিক্ষার এক বিশেষ নৈতিক ভিত্তি রয়েছে আর তা হলো এই যে শিক্ষা মনুষ্যত্বের বাহন এবং সে কারণেই তা শাশ্বত। এ হিসেবে শিক্ষার এক শাশ্বত উদ্দেশ্যও রয়েছে। ২. শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার এই উদ্দেশ্য ও নৈতিক ভিত্তিকে ধসিয়ে দিচ্ছে। ৩. যেহেতু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ এই শাশ্বত নৈতিক ভিত্তিকে এবং শিক্ষার উদ্দেশ্যকে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে সে কারণেই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য চলে না। সমাজটা পুঁজিবাদী হলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে কোন প্রকার পুঁজিবাদী সম্পর্ক থাকা চলবে না। যেহেতু শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য চলে না সুতরাং রাষ্ট্রকেই শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব বহন করতে হবে। ৪. মাদ্রাসা শিক্ষা কোন প্রকার নৈতিক শিক্ষাকে ধারণ করে না। ৫. বর্তমান পুঁজিবাদী অবক্ষয়ী আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থাই নীতি, নৈতিকতা মূল্যবোধসমূহকে সংহার করে চলেছে। ব্যস, এই পর্যন্ত।
খালেকুজ্জামানের এই সিদ্ধান্তসমূহ সম্পর্কে কোন প্রকার আলোচনার পূর্বে নৈতিকতা সম্পর্কে অ্যান্টি–ডুরিং এ নৈতিকতা এবং আইন : শাশ্বত সত্যসমূহ অধ্যায়ে এঙ্গেলস কি বলেছেন তা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
“….সামন্তবাদী অভিজাত, বুর্জোয়া এবং সর্বহারা তথা আধুনিক সমাজের তিনটি শ্রেণীর প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা নৈতিকতা আছে, ……সচেতনভাবে হোক কিংবা অচেতনভাবে হোক, মানুষ শেষ পর্যন্ত তার নৈতিকভাবসমূহ তার শ্রেণীগত অবস্থানের ভিত্তিতেই তৈরী করে; যে–আর্থিক সম্পর্কের মাধ্যমে তার উৎপাদন এবং বিনিময় কার্য সংঘটিত হয় সেই আর্থিক সর্ম্পকই তার নৈতিকতার ভিত্তি।”
“কাজেই নৈতিকতার জগতে এমন সব শাশ্বত নীতি রয়েছে যার স্থান ইতিহাস এবং জাতি সমূহের পার্থক্যের উর্ধে, এই যুক্তিতে কেউ যদি আমাদের উপর চরম, চিরন্তন এবং অন্তিম বলে কোন নৈতিক বিধানকে আরোপ করতে চান তবে তাঁর তেমন যে কোন প্রয়াসকে আমরা প্রত্যাখ্যান করব। বরঞ্চ আমরা বলব, আজ পর্যন্ত যত নৈতিক তত্ত্ব তৈরী হয়েছে শেষ বিশ্লেষণে তার প্রত্যেকটিই হচ্ছে সমাজে বিরাজমান অর্থনৈতিক অবস্থার ফল। এবং যেহেতু সমাজ আজ পর্যন্ত শ্রেণী দ্বন্দ্বে বিভক্ত সে কারণে সমাজে বিদ্যমান নৈতিকতা হচ্ছে শ্রেণী–নৈতিকতা : এ নৈতিকতা হয় শাসক শ্রেণীর স্বার্থ এবং প্রভুত্বের পক্ষে যুক্তি যুগিয়েছে, নয়ত নির্যাতিত শ্রেণী যখন যথেষ্ট শক্তি সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে তখন সে শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে এবং শোষিতের ভবিষ্যৎ স্বার্থের প্রকাশ ঘটিয়েছে।”১৩
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকে ধসিয়ে দিচ্ছে– বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজের শিক্ষা সম্পর্কেই এ কথা বলা হচ্ছে, বুর্জোয়ারাই এখানে শাসক শ্রেণী। এই পুঁজিবাদী সমাজে মানুষে মানুষে সম্পর্কের রূপটি কেমন সে সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টো–তে বলা হয়েছে: “বুর্জোয়া শ্রেণী যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও প্রকৃতি–শোভন সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। যে সব বিচিত্র সামন্ত বাঁধনে মানুষ বাঁধা ছিল তার ‘স্বভাবসিদ্ধ উধর্¦তন’দের কাছে, তা এরা ছিঁড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে। মানুষের সাথে মানুষের আনাবৃত স্বার্থের বন্ধন, নির্বিকার ‘নগদ টাকার’ বাঁধন ছাড়া আর কিছুই এরা বাকি রাখে নি। আত্মসর্বস্ব হিসাবনিকাশের বরফজলে এরা ডুবিয়ে দিয়েছে ধর্ম–উন্মাদনার স্বর্গীয়–ভাবোচ্ছাস, শৌর্যবৃত্তির উৎসাহ ও কূপমন্ডুক ভাবালুতা। লোকের ব্যক্তি মূল্যকে এরা পরিণত করছে বিনিময় মূল্যে, অগণতি অনস্বীকার্য সনদবদ্ধ স্বাধীনতার স্থলে এরা এনে খাড়া করল ওই একটিই নির্বিচার স্বাধীনতাঅবাধ বাণিজ্য। এক কথায়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভ্রমে যে শোষণ এতদিন ঢাকা ছিল, তার বদলে এরা এনেছে নগ্ন, নির্লজ্জ, সাক্ষাৎ, পাশবিক শোষণ।
“মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এতদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, কবি, বিজ্ঞানী– সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরী–ভোগী শ্রমজীবী রূপে।”
মানুষের সাথে মানুষের আনাবৃত স্বার্থের বন্ধন, নির্বিকার ‘নগদ টাকার’ বাঁধন ছাড়া আর কিছুই এরা বাকি রাখে নি। … লোকের ব্যক্তি মূল্যকে এরা পরিণত করছে বিনিময় মূল্যে……….চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, কবি, বিজ্ঞানী– সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরী–ভোগী শ্রমজীবী রূপে– এই হলো পুঁজিবাদ, এই হলো শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী। এই শাসক বুর্জোয়া শ্রেণী শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণ করছে এই অভিযোগ তোলার মানেটা কি? ঐতিহাসিকভাবে ঠিক এ কাজটিই তো তাদের করার কথা! কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখানে নয়। আমরা বরং নৈতিকতার প্রশ্নে ফিরে যাই।
শাসক শ্রেণী শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতা ধ্বংস করছে। প্রথমতঃ এই নৈতিকতার শ্রেণী চরিত্র রয়েছে। সচেতনভাবে হোক কিংবা অচেতনভাবে হোক, মানুষ শেষ পর্যন্ত তার নৈতিকভাবসমূহ তার শ্রেণীগত অবস্থানের ভিত্তিতেই তৈরী করে। এই নৈতিকতার ভিত্তি কি? যে–আর্থিক সম্পর্কের মাধ্যমে তার (অর্থাৎ নির্দিষ্ট শ্রেণীটির) উৎপাদন এবং বিনিময় কার্য সংঘটিত হয় সেই আর্থিক সর্ম্পকই তার (অর্থাৎ সেই শ্রেণীর) নৈতিকতার ভিত্তি। দ্বিতীয়তঃ শিক্ষার এই নৈতিকতার শ্রেণী উদ্দেশ্য রয়েছে। যেহেতু সমাজ আজ পর্যন্ত শ্রেণী দ্বন্দ্বে বিভক্ত সে কারণে সমাজে বিদ্যমান নৈতিকতা হচ্ছে শ্রেণী–নৈতিকতা : এ নৈতিকতা (হয়) শাসক শ্রেণীর স্বার্থ এবং প্রভুত্বের পক্ষে যুক্তি যুগিয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতা নির্ধারিত হয় কোন শ্রেণীর স্বার্থে, কোন শ্রেণীর দ্বারা? নিঃসন্দেহে তা শাসক শ্রেণী দ্বারা শাসক শ্রেণীরই স্বার্থে। সুতরাং বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী যদি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকে ধ্বংস করে থাকে তো তা শাসক শ্রেণীর নিজের উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকেই ধ্বংস করার সামিল। অর্থাৎ শাসক শ্রেণী নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারছে। অন্ততঃ খালেকুজ্জামানের বক্তব্য তাই। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিলাপ করার প্রয়োজনটা কি? আর যদি পরিস্থিতিটা এমন হয় যে, শাসক শ্রেণীর সাংস্কৃতিক চরিত্রগত কিছু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে বলে (নিঃসন্দেহে সে পরিবর্তনের অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে) তার নৈতিকতা এমন ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে যা অতীতের তুলনায় নিুগামী তো সেক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর কাজটা কি শাসক শ্রেণীরই সেই অতীতের নৈতিকতায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করা? নাকি এঙ্গেলস যেমনটি বলেছেন, “.. যে নৈতিকতার ভেতরে স্থায়ীত্বের সম্ভাবনার উপাদান রয়েছে অধিক, অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণীর নৈতিকতা,যার লক্ষ্য বর্তমানের উচ্ছেদ এবং ভবিষ্যতের প্রতিষ্ঠা।”১৪ শ্রমিক শ্রেণীর সেই উচ্চতর নৈতিকতা দিয়ে বুর্জোয়া নৈতিকতা আর অধঃপতনের বিরুদ্ধে লড়াই করা? শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকে ধসিয়ে দিচ্ছে– এ কথা বলে খালেকুজ্জামান শাসক শ্রেণীকে একাধারে অভিযুক্ত করছেন অপরদিকে সাবেকি নৈতিকতার স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ছেন।‘বিপ্লব মানে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিকতার নতুন নির্মাণ’ এই আওয়াজ তুলে বুর্জোয়া সাংস্কৃতিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে খালেকুজ্জামানের সংগঠন তাই আজ আওয়াজ তুলছে ‘শিক্ষা, সংস্কৃতি, মনুষ্যত্ব ধ্বংসের চক্রান্ত রুখে দাঁড়ান’।
“বস্তুত যখন থেকে মানুষের সমাজে সম্পত্তির উপর ব্যক্তিগত মালিকানা বিকাশলাভ করেছে, তখন থেকে যে–সমাজে ব্যক্তিগত মালিকানা রয়েছে সে সমাজেরই অন্যতম নৈতিক বিধান হয়েছে: ‘হে মানুষ, তুমি অপরের দ্রব্য চুরি করিবে না’।”১৫ এখন বুর্জোয়ারা নিজেরাই যদি এই নৈতিক বিধান শিকেয় তুলে রেখে চুরিতে মেতে ওঠে তো সেক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধিরা কি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলবে যে তারা নৈতিকতাকে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে? নাকি এমন সমাজ গঠনের কর্মসূচি হাজির করবে যেখানে চুরি করার কারণটিই দুর করা গেছে?
অতীতের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখা, অতীতের জন্য হাঁ হুতাশ– নিঃসন্দেহে তা, শ্রেণী হিসেবে আধুনিক শিল্প উৎপাদনের সৃষ্টি সর্বশেষ শ্রেণী, শ্রমিক শ্রেণীর কাজ নয়। বুর্জোয়া শ্রেণীর তো নয়ই। একাজটা তাহলে কোন শ্রেণীর? কমিউনিস্ট পার্টির মেনিফেস্টো–তে তার ইঙ্গিত রয়েছে: “নিুধ্যবিত্ত, ছোট হস্তশিল্প কারখানার মালিক, দোকানদার, কারিগর, চাষী– এরা সকলে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়ে মধ্য শ্রেণীর টুকরো হিসাবে নিজেদের অস্তিত্বটাকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাবার জন্য। তাই তারা বিপ্লবী নয়, রক্ষণশীল। বলতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীলও, কেননা ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘুরাবার চেষ্টা করে তারা।”
খালেকুজ্জামানের এরপরের বক্তব্যে:‘শিক্ষা মনুষ্যত্বের বাহন। সেজন্যই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করা চলে না।’ তাহলে তাঁর অভিযোগ এটা নয় যে, বুর্জোয়ারা নিজেরাই নিজেদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে। বরং তাঁর অভিযোগ বুর্জোয়ারা শিক্ষার এমন এক নৈতিকতাকে ধ্বংস করছে যা শ্রেণীর উর্ধ্বে, শাশ্বত। শিক্ষার নৈতিকতা শাশ্বত, শ্রেণীর ঊর্ধ্বে, কেননা শিক্ষা মনুষ্যত্বের বাহন। শিক্ষার নৈতিকতা যদি শাশ্বত না–ই হয় তাহলে তাহলে এ বক্তব্য হাজির করার কোনই মানে হয় না যে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করা চলে না।
আমরা আগেই দেখেছি অ্যান্টি–ডুরিং–এ এঙ্গেলস শ্রেণী বিভক্ত সমাজে নৈতিকতার শ্রেণী চরিত্রটি কিভাবে স্পষ্ট করেছেন, দেখিয়েছেন যে শ্রেণীর উর্ধ্বে নৈতিকতা বলতে সমাজে কিছু নেই। এঙ্গেলস এরপর বলেছেন: “যথার্থভাবে মানবিক নৈতিকতা, যে–নৈতিকতা শ্রেণী–দ্বন্দ্ব এবং তার স্মৃতিরও উর্ধ্বে অবস্থিত তেমন নৈতিকতা সম্ভব হবে সমাজের একমাত্র সেই পর্যায়ে যেখানে কেবল যে শ্রেণী–দ্বন্দ্ব অতিক্রান্ত হয়েছে, তাই নয়, যেখানে বাস্তব জীবনে মানুষ সেটা বিস্মৃত হয়েছে।”১৬ এঙ্গেলস স্পষ্টতই এমনকি সমাজতান্ত্রিক সমাজের কথাও বলছেন না, সাম্যবাদী সমাজের কথা বলছেন, যেখানে শ্রেণীর ঊর্ধ্বে যথার্থ মানবিক নৈতিকতা সম্ভব। বর্তমানকালে শিক্ষা মনুষ্যত্বের বাহন একারণেই শ্রেণীর উর্ধ্বে অবস্থিত শিক্ষার এক শাশ্বত নৈতিকতার কথা বলা কেবল অনৈতিহাসিকই নয়, অ–মার্কসীয়ও বটে।
এখানে শুধু আরেকটু যোগ করার আছে। একজন পুঁজিপতির জীবনকে আমরা এভাবে দেখতে পারি: M-C-M। শুরুতে পুঁজিপতির হাতে থাকে M (money) অর্থাৎ টাকা। তা দিয়ে সে C (comodity)- কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, কারখানা, শ্রমশক্তি ইত্যাদি ক্রয় করে এবং এরপর উৎপাদনে যায়, তৈরী করে নতুন সব পণ্য যা বাজারে বিক্রি করে তার হাতে আসে M টাকা। কিন্তু এই আবর্তনে পুঁজিপতির হাতে (M–M)পরিমাণ বাড়তি টাকা অর্থাৎ মুনাফা জমা হয়েছে। এই মুনাফাই পুঁজিপতির জীবনের লক্ষ্য, তার জীবনের মূল চালিকা শক্তি; বস্তগতভাবে, আধ্যাত্মিকভাবে। অপরদিকে শ্রমিকের জীবনচক্রটা হলো C-M-C – শ্রমিকের আছে কেবল শ্রমশক্তি, পুঁজিবাদ যাকে পণ্যে রূপান্তরিত করেছে। এই পণ্য C, পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করে শ্রমিকের হাতে আসে টাকা M, যে টাকা দিয়ে সে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ভোগের সামগ্রী, পণ্যাদি C ক্রয় করে। উৎপাদনের সাথে পুঁজিপতি আর শ্রমিকের জীবনের সম্পর্কের এই বস্তুগত পার্থক্যই তাদের পৃথক সংস্কৃতি, পৃথক নৈতিকতার ভিত্তি। এ বিষয়টি লক্ষ্য করেই এঙ্গেলস বলেছেন: যে–আর্থিক সম্পর্কের মাধ্যমে তার (অর্থাৎ নির্দিষ্ট শ্রেণীটির) উৎপাদন এবং বিনিময় কার্য সংঘটিত হয় সেই আর্থিক সর্ম্পকই তার (অর্থাৎ সেই শ্রেণীর) নৈতিকতার ভিত্তি।
শিক্ষা ও নৈতিকতা সংশ্লিষ্ট অপর এক অংশের শিরোনাম ‘মাদ্রাসা শিক্ষা নৈতিক শিক্ষাকে ধারণ করে না’। মাদ্রাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে এক মোক্ষম যুক্তিই বটে! আসলেই কি তাই? মাদ্রাসার মাধ্যমে কি কোন প্রকার নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা হয় না? ইসলামী মূল্যবোধ উৎপাদন ও পুনোরুৎপাদন, চিন্তার জগতে সামন্ত কাঠামোর আধিপত্য বজার রাখা; সামন্ত–ইসলামী নৈতিকতা, এটাই হচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার কার্যকর নৈতিকতা। এটা অস্বীকার করার অর্থ মাদ্রাসা শিক্ষার শ্রেণী ভিত্তি, শ্রেণী লক্ষ্য অস্বীকার করা।১৭
‘বর্তমান পুঁজিবাদী অবক্ষয়ী আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থাই নীতি, নৈতিকতা মূল্যবোধসমূহকে সংহার করে চলেছে’ খালেকুজ্জামান যখনই নীতি নৈতিকতার প্রসঙ্গে আলোচনা করেন তা কোন শ্রেণীর নীতি নৈতিকতা সেটি উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন তিনি বোধ করেন না। সম্ভবত তাঁর কাছে নৈতিকতার কোন শ্রেণী চরিত্র নেই বলেই এক্ষেত্রে শ্রেণীর উল্লেখ তিনি অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন।
রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের অর্থ কি?
এখন দেখা যাক রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা প্রসঙ্গে খালেকুজ্জামান কি বলেন। আমরা আগেই দেখেছি তিনি দাবি করেছেন: ‘প্রথম শ্রেণী থেকে স্নাতক পর্যন্ত একই ধারার বাধ্যতামূলক সমন্বিত শিক্ষা চালু করতে হবে’– বাধ্যতামূলক তার মানে রাষ্ট্রকেই শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করতে হবে। পরে এটাকেই পৃথকভাবে হাজির করা হয়েছে: ‘শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে’। এই দাবিগুলির পেছনে যে যুক্তি খালেকুজ্জামান তাঁর পুস্তিকায় উপস্থিত করেছেন তার মূল কথাটা হলো এই যে, ‘শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে’। এবং ‘শিক্ষা মনুষ্যত্বের বাহন। সেজন্যই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করা চলে না। ক্রেতা–বিক্রেতা সম্পর্কে দর–দাম যাচাই এর প্রেক্ষিতে আর যাই হোক শিক্ষা হয় না।’ এবং ‘শিক্ষা যখনই বাণিজ্যিক পণ্য হয়ে ওঠে, তখনই শিক্ষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নষ্ট হয়ে যায়।’ অর্থাৎ যেহেতু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ শিক্ষার নৈতিক ভিত্তি ও উদ্দেশ্যকে ধ্বসিয়ে দিচ্ছে সে কারণেই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য চলে না। এই যুক্তির ডালপালা বেয়েই এরপর অবশ্যম্ভাবীভাবে এসে যায় এই দাবিটি যে, শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব তাই রাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে। শিক্ষাকে পণ্য হওয়ার কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে হবে অর্থাৎ বিদ্যমান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনেই শিক্ষাকে পুঁজিবাদী সম্পর্কের উর্ধ্বে স্থাপন করতে হবে। খালেকুজ্জামান–এর বক্তব্য আরো সহজ করে বললে তা দাঁড়ায় এই যে, শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব সরকারকেই বহন করতে হবে কেননা এটা তার নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব রাষ্ট্র যদি পালন না করে তাহলে ‘শিক্ষার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নষ্ট হয়ে যায়’।
সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার বাস্তবায়ন সামন্তবাদের উপর পুঁজিবাদের বিজয়ের ফলেই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু একাজ পুঁজিবাদ করেছে মনুষ্যত্বের বাহন হিসেবে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নৈতিকতাকে রক্ষার কোন নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করেছে বলে নয়– এ বিষয়ে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।
শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে সমাজের স্থলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজন পড়েছিল প্রধানত দু’টো কারণে। প্রথমত, দেখা গেল স্থানীয় উদ্যোগে ও স্থানীয় কর প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক শিক্ষার বিস্তার সম্ভব হচ্ছে না। এলাকাভেদে করের কম–বেশি হয়, পুঁজিবাদী উৎপাদন বজায় রাখতে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্বও সবার কাছে সমান স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, এতে করে শিক্ষার মানের তারতম্য হতো। একমাত্র সরাসরি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া এই দুই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেই বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব বুর্জোয়া শ্রেণীর পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রকেই পালন করতে হয়।
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার, বা উচ্চ শিক্ষার বিভিন্ন স্তর পর্যন্ত শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের আরেকটি দিক আছে। একচেটিয়া পুঁজির যুগে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলন শক্তিশালী হতে থাকার সাথে সাথে কেবল ব্যক্তিগত মজুরী দিয়েই শ্রমিককে তার শ্রমশক্তির দামটা চুকিয়ে দেয়া হয় না। এর পাশাপাশি আবির্ভাব ঘটেছে ‘সামাজিক মজুরী’র (social wage)। ব্যক্তি হিসেবে কে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কতটুকু অবদান রাখলো তার আলাদা কোন হিসেব নিকেশ ছাড়াই সমাজ বা রাষ্ট্র একজনকে যে সুবিধাটুকু প্রদান করে তা–ই হলো সামাজিক মজুরী।১৮ লেনদেনটা এখানে নগদ অর্থে হয় না: বিনামূল্যে প্রাথমিক (বা মাধ্যমিক) শিক্ষা, শিশুদের জন্য টিকা, পাঠাগার ইত্যাদি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ইউরোপের বহু দেশে এই ‘সামাজিক মজুরী’ আরো সম্প্রসারিত হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে তা উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
এই যে ‘বিনামূল্যে’ বলা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে তা বিনামূল্যে নয়। প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা করে এর জন্য হয়তো খরচ করতে হয়না, কিন্তু রাষ্ট্রকে সে জন্য ‘খরচ’ করতেই হয়। রাষ্ট্র এই খরচটা তার নিজস্ব সম্পদ থেকে বহন করে, অর্থাৎ ট্যাক্স ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রের হাতে যে উদ্বৃত্ত–মূল্য সংগৃহিত হয় তার মাধ্যমে। ‘সামাজিক মজুরী’কে তাই নাগরিকদের সুনির্দিষ্ট কিছু চাহিদা মেটানোর বা বিতরণ ব্যবস্থার একটি অংশের সামাজিকীকরণ বলা চলে।
স্পষ্টতই শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের মাধ্যমে রাষ্ট্র চাহিদা–নির্ভর এক অর্থনৈতিক সম্পর্ক চালু করছে, যার যতটুকু দরকার সে ততটুকু পাচ্ছে- এভাবে পণ্য অর্থনীতির সাথে পার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থাৎ পণ্য অর্থনীতিতে যেমন পণ্যাদি বা সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে বিনিময়ে পাই–পয়সা হিসেব করে নেয়া হয়, এখানে সেটা হচ্ছে না। কিন্তু এর দ্বারা কি শিক্ষার পণ্য চরিত্র পুরো খর্ব করা গেলো?
প্রথমত, যার যতটুকু দরকার সে ততটুকু পাবে, এরও একটা সীমানা আছে। অধিকারের এই সীমানা কিভাবে নির্ধারিত হয় তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। দ্বিতীয়ত, বিতরণ ব্যবস্থার উপরোক্ত আংশিক সামাজিকীকরণ ঘটে খোদ পুঁজিবাদী সমাজের অভ্যন্তরেই। এর শরীরে তাই লেগে থাকে পণ্য উৎপাদনকারী সমাজের, শ্রেণী সমাজের সব রকমের চিহ্ন– সম্পদের আধিক্য নয়, ঘাটতির চেহারাটাই এখানে দেখা যায়। বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা, শিশুদের টিকা সব কিছুতেই ভাবটা থাকে এমন যেন রেশন বিতরণ করা হচ্ছে, নিতান্ত দয়া করা হচ্ছে। নজরটা থাকে কম কম করে দেবার, যেন ঘাটতি পড়বে শিগগীরিই। মালিক শ্রেণীর রাষ্ট্র একাজটা করে মোট সামাজিক উৎপাদনকে আরো ন্যায়সঙ্গত ভিত্তিতে বিতরণের উদ্দেশ্যে নয়। বরং এই সামাজিক মজুরীর গ্রাহক শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষেরা যাতে উৎপাদনের কাজে নিজেকে আরো ভালোভাবে নিয়োজিত করতে পারে সেজন্য। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে বুর্জোয়া শ্রেণীর কেন্দ্রীয় হিসাব রক্ষক হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করছে, মজুরীর একাংশকে যৌথ মজুরী হিসেবে প্রদান করছে মাত্র।
অর্থাৎ ‘মনুষ্যত্ব’ রক্ষার কোন তাগিদ থেকে নয়, পুরোপুরি শ্রেণী স্বার্থেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ‘বিনামূল্যে’ প্রাথমিক শিক্ষা এবং ক্ষেত্র ও পরিস্থিতি বিশেষে উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে।
গোথা কর্মসূচির সমালোচনা–তেই বিনা বেতনে শিক্ষা সম্পর্কে মার্কস লিখেছেন: “‘সার্বজনীন বাধ্যতামূলক স্কুলগমন। বিনা বেতনে শিক্ষাদান।’ প্রথমটি জার্মানীতে আছে, দ্বিতীয়টি সুইজারল্যান্ডে এবং প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রেও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন অঙ্গরাজ্যে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ‘বিনা খরচায়’ পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকে, তবে কার্যতঃ তার অর্থ হচ্ছে, সাধারণের করের টাকা থেকে উচ্চ শ্রেণীগুলির শিক্ষার খরচ বহন করা।”
বিনা বেতনে শিক্ষাদান বা রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষার খরচ বহনের প্রশ্নটিকে শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিতে বিবেচনা করেছেন মার্কস। মার্কসের আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে যে, এই বিষয়ে দু’টো প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট। কোন শ্রেণীগুলির শিক্ষার খরচ বহন করা হবে? কোন শ্রেণীগুলি সে খরচ বহন করবে? রাষ্ট্র যখন শিক্ষার জন্য খরচ করে সে টাকার উৎস যে সাধারণের করের টাকা সেদিকে মার্কস আঙ্গুল তুলে দেখান।১৯
কোন শ্রেণী এই ‘সামাজিক মজুরীর’ যোগান দিচ্ছে? শ্রমিক–কৃষক আর শ্রমজীবী মানুষেরাই। প্রথমত উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করার মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত পরোক্ষ করের মাধ্যমে প্রাপ্ত মজুরীর একাংশ প্রদান করে। সুতরাং শিক্ষার ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করুক এই দাবির সপক্ষে যুক্তি হাজির করতে কোন নৈতিকতার দোহাই পারার প্রয়োজন নেই। “বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে, নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের আবেদন আমাদেরকে এক ইঞ্চিও সাহায্য করে না; নৈতিক ঘৃণা যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের যুক্তিকে তা সাহায্য করে না– তা শুধুমাত্র একটি লক্ষণ প্রকাশ করে। তার চাইতে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের কাজ হয়ে দাঁড়ায় এটা দেখানো যে, সাম্প্রতিককালে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সামাজিক অন্যায় বিদ্যমান উৎপাদন পদ্ধতিরই ফলাফল; কিন্তু একই সময়ে তা তার ভাঙ্গনেরও ইঙ্গিত; একই সঙ্গে এটা পরিষ্কার করা দরকার হয়ে পড়ে যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক আধারগুলোর ভাঙ্গনের সাথে সাথে ভবিষ্যৎ উৎপাদন ও বিনিময়ের সংগঠনগুলোর উপাদান বিকশিত হচ্ছে যা উপরোক্ত অন্যায়গুলোর অবসান ঘটাবে।”২০
এখানে আরেকটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা প্রধানত রাষ্ট্রের হাতে। প্রধানত মধ্যবিত্ত–উচ্চমধ্যবিত্তের সন্তানেরা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সাম্প্রতিককালে বিশ্ববিদ্যালয় খাতে সরকারি বরাদ্দ হ্রাস করা হচ্ছে, ফি সমূহ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এ বরাদ্দ হ্রাস এবং ফি বৃদ্ধির সাথে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী বাজার–উদারীকরণ নীতি বা মুক্তবাজার অর্থনীতির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। এ নীতির আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক খাতে সরকারি বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ হলো শ্রমজীবী জনগণের ‘সামাজিক মজুরী’ হ্রাসেরই এক প্রক্রিয়া। আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে যে ব্যয় বরাদ্দ হয় তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই শ্রেণীগত ঝোঁক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শ্রমজীবী পরিবারের সন্তানেরা যেহেতু কমই পৌঁছান, ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি বরাদ্দ হ্রাস বা ফি বৃদ্ধি আপাতভাবে শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থকে কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে না বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এটা ঘটছে সাম্রাজ্যবাদী বাজার–উদারীকরণ নীতির অংশ হিসেবে, যে নীতি বাস্তবায়নের ফলে সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন শ্রমজীবী জনগণ। এ অবস্থায় ফি বৃদ্ধি ও বরাদ্দ হ্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্র সংগঠনসমুহ যে আন্দোলন পরিচালনা করছেন, তা শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান শ্রেণী বৈষম্য এবং সাম্রাজ্যবাদ উভয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেই পরিচালনা করতে হবে। তা না হলে শেষ পর্যন্ত এমন আন্দোলন মধ্যবিত্তের আন্দোলন হিসেবেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। শেষ অবধি তা কেবল উচ্চ শিক্ষার আন্দোলনে পরিণত হবে, এমনকি বিকশিত হয়ে সকল প্রকার শ্রেণী চিন্তা থেকে ছাত্র আন্দোলন–ছাত্র সংগঠনকে বিচ্ছিন্ন করবে। ঠিক এটাই ঘটেছে খালেকুজ্জামান ও তাঁর সংগঠনের ক্ষেত্রে।
উচ্চ শিক্ষা যেভাবে শ্রেণী সংগ্রামকে প্রতিস্থাপিত করেছে
‘উচ্চ শিক্ষা হবে সবার জন্য অবারিত’ দাবি করেছেন খালেকুজ্জামান। দাবি করেছেন ‘প্রত্যেক জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে’। বিদ্যমান রাষ্ট্রের অধীনে সকল মানুষের সমান শিক্ষা বা সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার দাবি যে অবাস্তব এবং এমনকি রাজনৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল দাবি তা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। খালেকুজ্জামান–এর মনোজগতে কিন্তু উচ্চ শিক্ষা তার কুলীন আসন শক্তভাবেই গেড়ে বসেছে। তাঁর লেখাতে উচ্চ শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রে খোদ শ্রেণী সংগ্রামকেই প্রতিস্থাপন করে বসে আছে।
পৃষ্ঠা ১৪: ‘যতো তাড়াতাড়ি আমরা জীবন মানের উন্নতি চাই, অভাব–দারিদ্র–বেকারত্ব ও অনিশ্চয়তার অভিশাপমুক্ত জীবন চাই, ততো দ্রুত শোষণমুক্ত আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থা নির্মাণের চেতনা ও সংগ্রামের আধারে উচ্চ শিক্ষায় দেশের সকল লোককে শিক্ষিত করা চাই।’
বাক্যের শেষের অংশটি– শোষণমুক্ত আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থা নির্মাণের চেতনা ও সংগ্রামের আধারে উচ্চ শিক্ষায় দেশের সকল লোককে শিক্ষিত করা চাই– এর মানেটা কি? সংগ্রামের আধারে মানে কি বাসদ–এর আধারে দেশের সকল লোককে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা চাই? মানে সকলেই উচ্চ শিক্ষা লাভ করবে এবং বাসদ করবে, তাহলেই বিপ্লব করা সম্ভব হবে? আর যতো দ্রুত সকলে উচ্চ শিক্ষিত হবে ততো দ্রুত দেশে বিপ্লব হবে? সকলেই যাতে উচ্চ শিক্ষিত হয় এই জন্যই তাহলে আমাদের দাবি–আওয়াজ তুলতে হবে, সকল কর্মশক্তি ও সম্পদ নিয়োজিত করতে হবে। এভাবে উচ্চ শিক্ষার পথ ধরে শ্রেণী সংগ্রাম বিকশিত হবে।
মার্কস–এর কিন্তু শাসক শ্রেণীর শিক্ষার উপর এতটা আস্থা ছিলো না। “‘মেনিফেস্টো’তে বর্ণিত নীতিগুলির শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবার ব্যাপারে মার্কস পুরোপুরি ও একান্তভাবে নির্ভর করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণীর বুদ্ধিগত বিকাশের উপর, মিলিত লড়াই ও আলোচনা থেকে যার উদ্ভব অনিবার্য।”২১ বিপ্লবের জন্য শ্রমিক শ্রেণীর বুদ্ধিগত বিকাশ অপরিহার্য, আর সে বিকাশ ঘটবে মিলিত লড়াই ও আলোচনা থেকে। শ্রেণী সংগ্রাম আর বিশ্লেষণ থেকে।
পৃষ্ঠা ১৪: ‘.. পুঁজিবাদী দুনিয়া পারস্পরিক সহযোগিতার নয়, মারমুখী প্রতিযোগিতার দুনিয়া। তাই আমেরিকাতে যদি শতকরা ৯০ জন উচ্চ শিক্ষিত লোক থাকে আমাদের ১০০ জনকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে।’
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তো নিছক আরো একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র নয়, বর্তমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র। তাহলে সাম্র্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম করতে আর শ্রেণী সংগ্রামের প্রয়োজন নেই! দারুণ! এ হলো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে বাসদীয় রণনীতি! কেবল একটিই সীমাবদ্ধতা, যুক্তরাষ্ট্র যদি চক্রান্ত করে শতকরা ১০০ জনকেই উচ্চ শিক্ষিত করে ফেলে, তখন কি হবে?
পৃষ্ঠা ১৫: ‘অনেকে যুক্তি করেন সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়ে গেলে রাস্তা ঝাড়ূ দেয়া, ময়লা পরিষ্কার করা, কিংবা গতর খেটে কৃষিকাজ, মুটের কাজ এগুলো করবে কারা? শ্রমের মর্যাদার ধারণা এদেশের সমাজমূলে কখনও গভীরভাবে প্রোথিত হয় নি। তাই শিক্ষাটা হয়ে আছে সুবিধার হাতিয়ার কিংবা শ্রমবিমুখ পরগাছাসুলভ মানসিকতার অবলম্বন। নইলে ভাবনার গতিটা এই দিক দিয়ে যাবে কেন?’
আচ্ছা, উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে একটা বড়ো বাধা তাহলে এমনধারা মনোভাব। এই অভিযোগে একাধারে শাসক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণী উভয়েই অভিযুক্ত। শাসক শ্রেণী- কেননা সে ভাবে সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়ে গেলে রাস্তা ঝাড়ূ দেয়া, ময়লা পরিষ্কার করা, কিংবা গতর খেটে কৃষিকাজ, মুটের কাজ এগুলো করবে কারা? এই ভাবনা থেকে সে সবার জন্য উচ্চ শিক্ষা চালু করে না। শোষিত শ্রেণী কেননা সে–ও ভাবে সবাই উচ্চ শিক্ষিত হয়ে গেলে রাস্তা ঝাড়ূ দেয়া, ময়লা পরিষ্কার করা, কিংবা গতর খেটে কৃষিকাজ, মুটের কাজ এগুলো করবে কারা? আর এই ভাবনা থেকে সে সবার জন্য উচ্চ শিক্ষার দাবিটি তোলে না। সমস্যার গভীর মূলদেশে ভালই প্রবেশ করেছেন কমরেড খালেকুজ্জামান!
শ্রমের মর্যাদার ধারণা এদেশের সমাজমূলে কখনও গভীরভাবে প্রোথিত হয় নি। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমের মর্যাদা কিভাবে বাস্তব রূপ লাভ করে (becomes materialised)? টাকার অংকে– যে যত বেশি টাকা আয় করবে সে ততই মর্যাদার উচ্চ আসনে আসীন। এ না হলে বুর্জোয়ারা সমাজে মর্যাদার আসনে আসীন হতে পারতো না। পুঁজিবাদী সমাজে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশেও এর কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।
আর এই মনোভাবের দরুন শিক্ষাটা হয়ে আছে সুবিধার হাতিয়ার কিংবা শ্রমবিমুখ পরগাছাসুলভ মানসিকতার অবলম্বন। এ নিতান্তই চেতনাগত ব্যাপার, পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের কোন ভূমিকা এখানে নেই!
পৃষ্ঠা ১৫: ‘তা ছাড়া উচ্চ শিক্ষিত লোক যদি কৃষিকাজ করে, তাহলে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি মান্ধাতার আমলে পড়ে থাকতে পারে না।’
হাতুড়েপনার আর শেষ নেই! উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা কৃষিকাজ করলেই কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ ঘটবে!! কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্ক এবং বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থানের সাথে তাহলে এর কোন সম্পর্ক নেই!!! দেখুন শ্রেণী সংগ্রামকে আবারো কিভাবে প্রতিস্থাপিত করেছে উচ্চ শিক্ষা।
এ প্রসঙ্গেই প্রায় সোয়াশো বছর পূর্বে সংবাদ প্রভাকর কি বলছে দেখুন: “কৃষিকার্যের ভার বহুদিন হইতে মূর্খ, অজ্ঞ এবং দীন চাষাদিগের হস্তে রহিয়াছে। সুতরাং উহার কোন ক্রমিক উন্নতি হইতেছে না। ….তাহার সেই মান্ধাতার আমলের অস্ত্র লইয়া সেই একইভাবে কৃষিকার্য করিতেছে। ….বর্তমান কৃষকদিগের দ্বারা কৃষিকার্যের উন্নতি কোনক্রমে সম্ভাবে না। আমাদের মতে কৃষিকার্যে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ভদ্র সন্তানেরা যখন বর্তমান কৃষককুলকে নিজ নিজ অধীনে নিযুক্ত করিয়া বাহুল্যরূপে কৃষিকার্য আরম্ভ করিবেন তখন …… কৃষকদিগের দুরাবস্থা দুর এবং কৃষি বিভাগের ক্রমোন্নতি হইতে থাকিবে …।”২২ খালেকুজ্জামানের বক্তব্যের সাথে কি অপূর্ব সামঞ্জস্য। পার্থক্য শুধু এটাই যে সংবাদ প্রভাকর যেখানে খোলাখুলিভাবে বৈজ্ঞানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত ভদ্র সন্তানদের দ্বারা কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশের কথা বলছে, খালেকুজ্জামান সেখানে একটু ঘুরিয়ে উচ্চশিক্ষিত লোকের দ্বারা এই উন্নতি সম্ভব বলছেন। উভয়েই কার্যত একই শ্রেণীর কথা বলছেন।
উচ্চ শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে কৃষি উৎপাদন পদ্ধতি বিকাশের পথ খালেকুজ্জামানের নির্দেশ করছেন তার আরেকটি রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। “সমাজের বৈষয়িক উৎপাদন–শক্তি বিকাশের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে এলে তার সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয় প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের, অর্থাৎ, আইনের ভাষা ব্যবহার করলে বলতে হয়, সংঘাত সৃষ্টি হয় এতদিন যে সম্পত্তি–সম্পর্কের মধ্যে থেকে উৎপাদন–শক্তি সক্রিয় ছিল তারই সাথে। সে সম্পর্ক উৎপাদন–শক্তির বিকাশের রূপ থেকে পরিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় উৎপাদন–শক্তির শৃখলে। তারপর শুরু হয় সামাজিক বিপ্লবের যুগ।”২৩ খালেকুজ্জামান কৃষিক্ষেত্রে বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে এখনো উৎপাদন–শক্তির বড়ো ধরনের বিকাশ– উচ্চ শিক্ষার প্রয়োগে মান্ধাতার আমল থেকে একবারে আধুনিক– সম্ভব বলে মনে করেন, অর্থাৎ সংস্কারের সম্ভাবনা দেখেন। সংস্কারবাদের ভাষা এমনই হয়।
পৃষ্ঠা ১৬–১৭: ‘গত ৬ জুলাই’র ডেইলী স্টার পত্রিকা থেকে জানা যায়, সাংগু তেলকূপ বৃটিশ কোম্পানীর কাছে ইজারা দিয়ে পুনরায় তাদের থেকে গ্যাস কিনে ১৫ বছরে বাংলাদেশের ২০০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে। …… কতো বড় সর্বনাশ দেশের জন্য! তারপরও এ–সবই মেনে নিতে হচ্ছে শাসকদের পক্ষ থেকে হাজির করা ‘আমাদের দক্ষতা–যোগ্যতা নেই’ যুক্তিকে শিরোধার্য করে।
‘স্বাধীনতার পর থেকে সকল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করা এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নিলে আজ এ দুর্গতি হতো না।’
অতিসরলীকরণের শেষ সীমানাও অতিক্রম করে গেছেন খালেকুজ্জামান। সম্পদের এই লুন্ঠনের সাথে যে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর চরিত্র এবং এদেশে সাম্রাজ্যবাদের অবস্থানের সম্পর্ক রয়েছে– খুবই স্থূলভাবে সেটা আড়াল করা হচ্ছে। কেবল উচ্চ শিক্ষার অভাবের দরুনই দেশের সম্পদ লুট হয়ে যাচ্ছে। শাসক শ্রেণীর দোষ কেবল এতটুকুই যে তারা সকল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করা এবং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়নি। সাম্রাজ্যবাদ প্রসঙ্গটি পুরোপুরি অনুপস্থিত।
আর এসবই আলোচিত হয়েছে শিক্ষা জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির পরিচালিকা শক্তি শীর্ষক অংশে। আপনি কাকে হিতোপদেশ দিচ্ছেন কমরেড খালেকুজ্জামান?
পেটিবুর্জোয়া হাতুড়েপনা
শিক্ষা নীতি ও শিক্ষার সংকট প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে পেটিবুর্জোয়া হাতুড়েপনা ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তার বহু মণিমুক্তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন খালেকুজ্জামান।
পৃষ্ঠা ৭: ‘শিক্ষা যতো উচ্চ স্তরের উৎপাদিকা শক্তি ততো বিকশিত পর্যায়ের।’
ঠিক তার উল্টো। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের উপরই নির্ভর করে শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশ। ‘উৎপাদন–সম্পর্কগুলির সমষ্টি হল সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, সেই আসল বনিয়াদ, যার উপর গড়ে ওঠে আইনগত ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো এবং সামাজিক চেতনার রূপগুলি হয় তারই অনুরূপ। বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিই সাধারণভাবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন–প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে।’২৪
পৃষ্ঠা ৯: ‘ .. আজ জগত ও জীবনের নিয়মসমূহকে সাধারণভাবে জানা, উৎপাদনের গতি বৃদ্ধি, সমাজের অসঙ্গতি দূর করার দক্ষতা ও শক্তি অর্জন করা এবং উচ্চতর মানবিক ও নৈতিক বোধের আধারে শাসনপ্রণালীতে জনগণের হিত–অহিতের বিষয় বুঝবার ও বুঝানোর মতো শিক্ষার স্তরে সকল মানুষকে তুলে আনার উদ্দেশ্য সামনে রেখেই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।’
খালেকুজ্জামানের এই হলো সমস্যা। মাঝে মাঝে তিনি ভুলে যান কাদের হয়ে কথা বলতে নেমেছেন, কাকে বলছেন, আর এত কথা বলার উদ্দেশ্যই বা কি। সমাজের অসঙ্গতি দূর করার দক্ষতা ও শক্তি অর্জন করা ’র প্রয়োজনকে সামনে রেখে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। সমাজের অসঙ্গতিটা কি? উৎপাদন হচ্ছে সামাজিকভাবে আর তার মালিকানাটা সংখ্যাল্পের হাতে– এটাই সমাজের, পুঁজিবাদী সমাজের মৌলিক অসঙ্গতি। এই অসঙ্গতি দূর করার দক্ষতা ও শক্তি অর্জন করার জন্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে একথার মানে দাঁড়ায়– এমন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে যা মানুষকে পুঁজিবাদের জোয়ালটা ছুড়ে ফেলতে শক্তি ও শিক্ষা দেয়। এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করবে শাসকশ্রেণী? নাকি খালেকুজ্জামান তাঁর পার্টির আভ্যন্তরীন শিক্ষার নীতি বর্ণনা করছেন? বিষয়টি অবশ্য পরিষ্কার হয় বাক্যের পরবর্তী অংশেই: শাসনপ্রণালীতে জনগণের হিত–অহিতের বিষয় বুঝবার ও বুঝানোর মতো শিক্ষার স্তরে সকল মানুষকে তুলে আনার উদ্দেশ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে। তাহলে জনগণের হিত–অহিতের বিষয় বুঝবার ঘাটতি রয়েছে সকলের– শাসক শ্রেণী শোষিত শ্রেণী উভয়েরই। এ যাবৎকাল পর্যন্ত সকল শিক্ষানীতি শাসকশ্রেণীকে জনগণের হিত–অহিতের বিষয় বুঝবার শিক্ষাটা ঠিক মতো দেয় নি বলেই না জনগণের এতো দুর্ভোগ।
পৃষ্ঠা ২২: ‘শিক্ষা জীবন শেষে প্রত্যেক মানুষকেই বৈষয়িক ও ভাবগত উৎপাদনের বিকাশ তথা সমাজ সভ্যতা বিকাশের কাজে তার সর্বোচ্চ মেধা–মনন ও সৃষ্টিশীল ক্ষমতা জীবনভর প্রয়োগ করে যেতে হয়। এটাই শিক্ষিত মানুষের সহজাত চেতনাগত বৈশিষ্ট্য।’
আরশোলার সহজাত চেতনাগত বৈশিষ্ট্য হলো রাতের অন্ধকারে রান্না ঘরে ঘুরঘুর করা; কোলাব্যাঙের সহজাত চেতনাগত বৈশিষ্ট্য হলো বর্ষায় ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ করা; বাঘের সহজাত চেতনাগত বৈশিষ্ট্য হলো হরিণ শিকার। শ্রমিকদের সহজাত চেতনাগত বৈশিষ্ট্য নোংরা থাকা, স্বাস্থ্য–শিক্ষা–পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে উদাসীন থাকা। আর শিক্ষিত মানুষের সহজাত চেতনাগত বৈশিষ্ট্য বৈষয়িক ও ভাবগত উৎপাদনের বিকাশ ঘটানো। সব কিছুই সহজাত অর্থাৎ প্রাকৃতিক– তাহলে আর মানুষ ও পশুতে পার্থক্য রইলো কোথায়, যে পার্থক্যের কথা খালেকুজ্জামান একাধিকবার উল্লেখ করেছেন? এবং চেতনাগত অর্থাৎ স্বয়ম্ভু।
এখন মার্কস কি বলছেন একটু শোনা যাক। “মানব–জীবনের সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে মানুষ জড়িত হয় কতগুলো অনিবার্য ও ইচ্ছা–নিরপেক্ষ নির্দিষ্ট সম্পর্কে, উৎপাদন–সম্পর্কে, যা মানুষের বৈষয়িক উৎপাদন–শক্তির বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের অনুরূপ। এই উৎপাদন–সম্পর্কগুলির সমষ্টি হল সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, সেই আসল বনিয়াদ, যার উপর গড়ে ওঠে আইনগত ও রাজনৈতিক উপরিকাঠামো এবং সামাজিক চেতনার রূপগুলি হয় তারই অনুরূপ। বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিই সাধারণভাবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন–প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে। মানুষের সত্তা তার চেতনা দ্বারা নির্ধারিত নয়, বরং ঠিক বিপরীতভাবে, মানুষের সামাজিক সত্তাই নির্ধারিত করে তার চেতনাকে।”২৫
শিক্ষা জীবন শেষে প্রত্যেক মানুষকেই বৈষয়িক ও ভাবগত উৎপাদনের বিকাশ তথা সমাজ সভ্যতা বিকাশের কাজে তার সর্বোচ্চ মেধা–মনন ও সৃষ্টিশীল ক্ষমতা জীবনভর প্রয়োগ করে যেতে হয় অর্থাৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে হয়। কিন্তু এই জড়িত হওয়াটা হয় কতকগুলি নির্দিষ্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে, যা কোন সহজাত বা প্রাকৃতিক ব্যাপার নয় বরং একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে সমাজের বৈষয়িক উৎপাদন–শক্তির বিকাশের তা অনুরূপ। এবং মোটেও তা চেতনাগত ব্যাপার নয়, এ হচ্ছে অনিবার্য ও ইচ্ছা–নিরপেক্ষ। আর মানুষের সত্তা তার চেতনা দ্বারা নির্ধারিত নয়, বরং ঠিক বিপরীতভাবে, মানুষের সামাজিক সত্তাই নির্ধারিত করে তার চেতনাকে।
তবে একটা জায়গায় খালেকুজ্জামান অন্ততঃ ঠিক, একপেশেভাবে হলেও নিজের অজান্তেই তিনি বুর্জোয়া শিক্ষার চেহারাটা উন্মোচন করেছেন। বৈষয়িক ও ভাবগত উৎপাদনের বিকাশটা হলো শিক্ষিত ভদ্রলোকদের সহজাত কাজ। অশিক্ষিত নোংরা শ্রমিক–কৃষক–শ্রমজীবী মানুষেরা একই কাজ করে বাধ্য হয় বলে। ঠিকই তো শিক্ষায় কাজ হলে বাধ্য করার প্রয়োজন কি, বলপ্রয়োগটা কেবল অশিক্ষিতদের জন্য।
পৃষ্ঠা ২২–২৩: ‘আমাদের দেশের আমলাদের পিয়ন, চাপরাশী, ব্যাটম্যান ইত্যাদি না হলে চলে না। অথচ উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে এ সবের অস্তিত্ব নেই। আমরা শিক্ষায় পিছিয়ে আছি, আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থার অসংগতির মধ্যে গোঁজামিল দিয়ে বেঁচে আছি। সেজন্য নিজেরা যেমন দাসসুলভ পরনির্ভর মানসিকতা ছাড়তে পারি না, তেমন চাকর–বাকর–চৌকিদার ছাড়াও চলতে পারি না। মিথ্যা মর্যাদার বদলে সত্যিকারের মর্যাদা শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করার স্বার্থেই এই মানসিকতার মধ্যে আমূল একটা পরিবর্তন আনতে হবে।’
এ যেন গত শতাব্দির প্রথম পাদের কোন আশ্রম থেকে ভেসে আসা ধর্মোপদেশ। উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশে ‘পিয়ন, চাপরাশী, ব্যাটম্যান’ নেই কেন? পুঁজিবাদের বিকাশ ও ব্যাপক শিল্পায়নের কারণে, কোন ধর্মোপদেশ বা খালেকুজ্জামানের কাছে যেটা শিক্ষা– তার ফলাফল নয় এটা। আমরা আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থায় গোঁজামিল দিয়ে বেঁচে আছি– এই আমরাটা এদেশের শ্রমজীবী মানুষ নয়, শাসকশ্রেণী আর অপরাপর অনুৎপাদক শ্রেণী; শ্রেণীর কথা বলতে আদপেই পছন্দ করেন না খালেকুজ্জামান, সবাই আমরা মানুষ এটাই তার কাছে যথেষ্ট।
যে দাসসুলভ পরনির্ভর মানসিকতার কথা বলা হচ্ছে সেটা শিক্ষার পশ্চাৎপদতার কারণে নয়। এর কারণ অষ্টাদশ শতকে এ অঞ্চলে মধ্যশ্র্রেণীর বিকাশ, বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের পদ্ধতি এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে এই শ্রেণীর সম্পর্কের মধ্যে খুঁজতে হবে। শিক্ষার পশ্চাৎপদতার কারণটাও সেখানেই খুঁজতে হবে। মার্কসীয় বিশ্লেষণে ‘বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন পদ্ধতিই সাধারণ–ভাবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন–প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে’। আর খালেকুজ্জামানের নয়া–মার্কসবাদে শিক্ষাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন–প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে।
আর শেষের বাক্যটির অর্থ বোঝাই মুশকিল। সহজ করে বললেই হয়, চাই আত্মার বিকাশ।
‘প্রকৃত শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি সে–শিক্ষা যা …….. জীবন এবং শ্রম (কায়িক–মানসিক)-কে অভিন্ন করে, পরগাছা সুলভ জীবনের প্রতি লজ্জা আনে এবং শ্রমের মর্যাদা ও সামাজিক চেতনা সম্পন্ন সত্যিকারের মর্যাদা বোধের ধারণা জন্ম দেয়।’
কায়িক ও মানসিক শ্রমের পার্থক্য কখন দূর হতে পারে সে সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায় মার্কসের লেখায়: “কমিউনিস্ট সমাজের উচ্চতর পর্যায়ে, শ্রম–বিভাগের নিকট মানুষের দাসসুলভ অধীনতা নিশ্চিহ্ন হবার পর; যখন সেই সাথে লোপ পাবে মানসিক ও কায়িক শ্রমের বৈপরীত্য; যখন শ্রম কেবল বেঁচে থাকার অবলম্বন না হয়ে পরিণত হবে জীবনের প্রাথমিক চাহিদায়; ..”।২৬ কমিউনিস্ট সমাজের উচ্চতর পর্যায়েই কেবল মানসিক ও কায়িক শ্রমের বৈপরীত্য লোপ পেতে পারে, জীবন ও শ্রম অভিন্ন হয়ে উঠে। এটা ঘটছে কেবল সমাজ বিকাশের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে গিয়ে। শিক্ষা দ্বারা এই পার্থক্য ঘুচানো সম্ভব নয়, কেননা এ শুধুই সদিচ্ছার বিষয় নয়। অথচ খালেকুজ্জামান এখনই চান এমন শিক্ষা যা জীবন এবং শ্রম (কায়িক–মানসিক)-কে অভিন্ন করে; এছাড়া কোন প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীদের এই হয় অবস্থা।
‘বৈষয়িক ও ভাবগত উৎপাদন সংগ্রামের মধ্যে প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে নিয়োজিত বিশ্বব্যাপী সকল মানুষের ভূমিকা এক হয় না, ব্যক্তিগত অবদান–অর্জনেরও তারতম্য ঘটে। কিন্তু তা যখন মানুষের কাছে জ্ঞান রূপে স্বীকৃতি লাভ করে এবং জ্ঞান ভান্ডারে জমা হয়, তখনই তা মানব জাতির সম্পদে পরিণত হয়।’
এবং তাই শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য চলে না এটাই ছিলো খালেকুজ্জামানের যুক্তি। এই যুক্তিতে সমাজের বৈষয়িক সম্পদের মালিকও গোটা মানব জাতি সুতরাং সেটা নিয়েও বাণিজ্য চলে না, এই যুক্তিতেই পুঁজিবাদও ঐতিহাসিকভাবে অযৌক্তিক। এই হলো পেটিবুর্জোয়াদের সমাজ বিশ্লেষণের পদ্ধতি। সমাজের এই অযৌক্তিক ভিত্তিটা বদলের জন্য যুক্তি ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় তাই খালেকুজ্জামানের সাধনা।
‘২ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত সময়কালের সমগ্র শিশুদের জন্য প্রত্যেকটি প্রাইমারী স্কুল সংলগ্ন প্রি–প্রাইমারী, নার্সারী জাতীয় প্রতিষ্ঠানের আয়োজন থাকা দরকার। এ শিশুদের রাষ্ট্রীয় পরিচর্যায় খাদ্য, পোষাক, খেলনা, শিক্ষার অন্যান্য উপকরণসহ স্বাস্থ্য সুবিধা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন। যেসব পরিবারে এসকল শিশুর রাত্রি যাপনের মতো ব্যবস্থাও নেই–সেই সব শিশুদের জন্য ২৪ ঘন্টার আবাসিক ব্যবস্থা করা দরকার। বিত্তশালী পরিবারের শিশুদেরও এ–ধরণের পরিচর্যার আওতায় আনা প্রয়োজন।’
‘যদিও এ কথা ঠিক যে, বর্তমান শোষণমূলক পুঁজিবাদী আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থা বহাল রেখে এ–ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন দুঃসাধ্য। তা–সত্ত্বেও আমাদের সর্বনাশের মাত্র যাই হোক পরবর্তী প্রজন্মকে এ–অভিশাপের হাত থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত রাখার জন্যই এ ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন দরকার।’
পুঁজিবাদী আর্থ–সামাজিক ব্যবস্থা বহাল রেখে এ–ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন দুঃসাধ্য দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয় বলেই খালেকুজ্জামান মনে করেন। যদিও একটু আগেই তিনি লিখেছেন: ‘আমাদের দেশের গ্রামীণ জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৬৭ ভাগ মানুষ ভূমিহীন এবং দিনমজুর। এদের অধিকাংশেরই স্থায়ী ঠিকানা নেই, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থান নেই।’ তাহলেও শ্রেণী সংগ্রাম বাদ দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে এ–অভিশাপ থেকে রক্ষা করতেই তিনি তৎপর। বিত্তশালী পরিবারের শিশুরাও প্রাচুর্যের পরিবেশে মানবিক দৈন্য নিয়ে বেড়ে উঠে—তাই তাদেরও তিনি রাষ্ট্রীয় খরচায় পরিচর্যা করতে চান। তা না হলে ভবিষ্যত কালের কাছে আমাদের সভ্যতার দাবী টিকবে কোন যুক্তিতে।
বিপ্লব না করেই তিনি বিপ্লবের ফলাফলটা চান।
‘প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য বিশাল আয়োজনের এত জায়গা কোথায়? বাস্তবে ক্রমে ক্রমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল শিক্ষক–শিক্ষার্থীর আবাসিক ব্যবস্থা করা গেলে প্রায় এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর থাকার ব্যবস্থা তো তার মধ্যেই পড়ে।’
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সকল শিক্ষক–শিক্ষার্থীর আবাসিক ব্যবস্থা করতে হবে কেন? খালেকুজ্জামানই সেটা ব্যাখ্যা করেছেন: ‘অতীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম দিকে একজন শিক্ষ–গুরু তার নিজ বাড়ীতে শিক্ষার্থীদের রেখে প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষা দিতেন। বর্তমানে জ্ঞান–বিজ্ঞানের নানাবিধ প্রসার–এর যুগে পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন ছাড়া কেবল কয়েকজন শিক্ষা–গুরুর মাধ্যমে এ–কাজটি সম্পাদন করা সম্ভব নয়।’ কিন্তু কোন সমাজে এই শিক্ষা–গুরুরা ছিলেন? প্রাকসামন্ত–সামন্ত সমাজে, যখন সমাজই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দায়িত্ব পালন করতো; যখন কেবল উচ্চ বর্ণেরই শিক্ষার অধিকার ছিল। আর খালেকুজ্জামান বলছেন বর্তমানকালের কথা, পুঁজিবাদী–সাম্রাজ্যবাদী যুগের কথা। যখন এদেশের গ্রাম ও শহরের শ্রমজীবী মানুষদের বাসস্থানের কোন খবরই রাষ্ট্র রাখছে না, শহরগুলোতে প্রতিদিনই বস্তি ভাঙ্গছে, বস্তিতে আগুন দিচ্ছে। এই সময়ে খালেকুজ্জামান একাধারে শিক্ষা ও বাসস্থান সমস্যার সমাধান হাজির করেছেন!
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাত্রই আবাসিক এই চিন্তার উদ্ভবের সম্ভবত আরেকটি অনুল্লেখিত কারণ রয়েছে। খালেকুজ্জামান সম্ভবত শিক্ষা বলতে ‘উচ্চ শিক্ষা’ বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকেই বুঝেন, তাঁর কাছে তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাত্রই বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রধানতঃ বিশ্ববিদ্যালয়। আর শিক্ষক–শিক্ষার্থীর আবাসিক ব্যবস্থা ছাড়া যেহেতু কোন প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে না, সুতরাং সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা মানেই একাধারে বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করা।
‘তাছাড়াও শিক্ষার জন্য জায়গা বেশি বরাদ্দ করলে শেষ পর্যন্ত থাকা–খাওয়া ও পরিবেশের সংকট হয় না। কারণ অশিক্ষিত মানুষের সামনে পৃথিবীময় প্রান্তর খুলে রাখলেও তারা কি ভালভাবে বাঁচতে পারবে?’
তাই তো, অশিক্ষিত মানুষের সামনে পৃথিবীময় প্রান্তর খুলে রাখলেও তারা কি ভালভাবে বাঁচতে পারবে? কি গভীর সমাজ চিন্তা!
‘একটা সচেতন পরিবার যেমন বয়স্কদের খাওয়ার টান পড়লেও ছেলে–মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়, তেমনি জাতিগত ভাবেও আমাদের আজ ভোগ–বিলাস, অপচয় ইত্যাদি সকল দিককে সংকুচিত করে শিক্ষার আয়োজন–উৎকর্ষ ও পরিধি বাড়াতে হবে।’
বেশ কমরেড খালেকুজ্জামান! কিন্তু ‘একটি সচেতন পরিবারে’ খাবারের টান পড়ে কেন? কেনইবা ‘খাওয়ার টান পড়লেও’ ছেলে–মেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়টি গুরুত্ব পায়? এর সাথে পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের কি সম্পর্ক?
জাতিগতভাবে আমাদের ভোগ–বিলাস, অপচয় ইত্যাদি সংকুচিত করতে হবে। এই ভোগ–বিলাস, অপচয় কারা করছে? শ্রমজীবী জনগণের খাদ্য–বাসস্থানের সংস্থান নেই, সেখানে ভোগ–বিলাস, অপচয়ের সুযোগ তারা কোথায় পাচ্ছেন। তারপরও জাতিগতভাবে ভোগ–বিলাস, অপচয় সংকোচনের এই উপদেশ দেবার বুদ্ধি আর সাহস খালেকুজ্জামান কোথায় পান? শাসক শ্রেণীর দায়–দায়িত্ব এভাবে শ্রমজীবী জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেয়াটাকে চক্রান্ত ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে?
প্রথমতঃ, তিনি বিপ্লব আকাঙ্খী কর্মীদের শিক্ষা দিচ্ছেন জনগণের জীবনের দুঃখ–কষ্টের কারণ ভোগ–বিলাস, পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদ নয়। দ্বিতীয়তঃ, এজন্য তিনি গোটা জাতিকে দায়ী করছেন। এভাবে শাসক শ্রেণীকেও তিনি আড়াল করছেন। কাজটা তিনি না বুঝে করছেন এমন ভাবার কোন কারণ নেই।
সবশেষে, সবার প্রথমেই যা বলা যেত
পৃষ্ঠা ৫: ‘ ‘সবার জন্য শিক্ষা’- এই নীতিকেই সাধারণভাবে সার্বজনীন গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি বলা হয়।’
বুর্জোয়া গণতন্ত্র মানে বুর্জোয়া শ্রেণীর জন্য গণতন্ত্র, শোষিতদের দাবিয়ে রাখার যন্ত্র। সর্বহারা শ্রেণীর গণতন্ত্র মানে শোষিতদের গণতন্ত্র, বুর্জোয়াদের দাবিয়ে রাখার যন্ত্র। কিন্তু সার্বজনীন গণতন্ত্র? এ যেন কাউৎস্কী’র ‘খাঁটি গণতন্ত্র’–এর খালেকুজ্জামানকৃত সংস্করণ। যে ‘খাঁটি গণতন্ত্র’ সম্পর্কে লেনিন তাঁর সর্বহারা বিপ্লব ও দলদ্রোহী কাউৎস্কী গ্রন্থে লিখেছেন: “যে–পর্যন্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে, সে–পর্যন্ত ‘খাঁটি গণতন্ত্রের’ কথা আমরা বলতে পারি না; আমরা কেবল বলতে শ্রেণী গণতন্ত্রের কথাই বলতে পারি। (বন্ধনীর ভেতরে বলতে হয় যে, ‘খাঁটি গণতন্ত্র’ কেবল নির্বোধ বুলিই নয়, যাতে প্রকাশিত হয় শ্রেণী–সংগ্রাম ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি– উভয়টি সম্পর্কেই উপলব্ধি–বোধের অভাব, বরং তা একবারেই অন্তঃসারশূন্য বুলিও বটে, কারণ কমিউনিস্ট সমাজে পরিবর্তন ও অভ্যাসে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্র ক্ষয় হতে হতে বিলীনই হয়ে যাবে, কিন্তু কখনই তা খাঁটি গণতন্ত্র হবে না।)
“‘খাঁটি গণতন্ত্র’ সেই উদারনীতিকেরই মিথ্যাচারপূর্ণ বুলি শ্রমিকশ্রেণীকে যিনি বোকা বানাতে চান। ইতিহাস অবগত আছে কেবল বুর্জোয়া গণতন্ত্র সম্পর্কেই যা সামন্ততন্ত্রের স্থান গ্রহণ করে, আর অবগত আছে সর্বহারা গণতন্ত্র সম্পর্কেই, যা স্থান গ্রহণ করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের।”২৭
খালেকুজ্জামান আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন সার্বজনীন গণতন্ত্রের– এমন গণতন্ত্র যা শ্রেণীর উর্ধ্বে। কাউৎস্কী’কে লেনিন বলেছেন দলদ্রোহী। কিন্তু খালেকুজ্জামানকে বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণী কি তা বলতে পারে?
শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের মাধ্যমে শাসক শ্রেণীর শিক্ষা সম্পর্কিত চিন্তা–ভাবনা ও বাস্তব কর্মকান্ডের প্রকাশ ঘটেছে। আর খালেকুজ্জামান–এর পুস্তিকাটির মধ্য দিয়ে এদেশের পেটিবুর্জোয়া মধ্যশ্রেণীর শিক্ষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশিত হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধিদের এখন কর্তব্য হলো শিক্ষা প্রসঙ্গে তাদের শ্রেণীগত চিন্তাকে দৃঢ়ভাবে, কোন ভানভণিতা ছাড়া জনসমক্ষে তুলে ধরা।।
টীকা ও তথ্যনির্দেশ
১. ১৮৭৫ সালে জার্মান শ্রমিকদের দু’টো সংগঠন বেবেল ও লাইবনেখ্ট–এর নেতৃত্বাধীন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক ওয়ার্কার্স পার্টি এবং লাসালের নেতৃত্বাধীন জেনারেল এসোসিয়েশন অব জার্মান ওয়ার্কার্স গোথায় অনুষ্ঠিত এক ঐক্য কংগ্রেসের মাধ্যমে সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি অব জার্মানী নামে একটি একক পার্টি গঠন করে। এই কংগ্রেসে পার্টি যে কর্মসূচি গ্রহণ করে তা গোথা কর্মসূচি নামে পরিচিতি লাভ করে। মার্কস এই কর্মসূচির যে সমালোচনা করেছিলেন তা পরবর্তীতে গোথা কর্মসূচির সমালোচনা নামে পরিচিতি লাভ করে।
২. Karl Marx, Critique of the Gotha Programme, p. 24, Marx-Engles Selected Works, Vol. II, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1962.
৩. Karl Marx, A Contribution to the Critique of Political Economy, Internet edition, //www.marxist.org.
৪. Fredrick Engles, Anti-Duhring, p. Foreighn Language Publising House, Moscow, 1962. অনুবাদ: এ্যান্টি–ড্যুরিং–এর দর্শন খন্ড বাংলায় অনুবাদ করেন সরদার ফজলুল করিম, ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সংস্কৃতি।
৫. কার্ল মার্কস–ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
৬. কার্ল মার্কস, পুঁজি, ১ম খন্ড, ১ম অংশ, পৃ. ৫৯২, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, ১৯৮৮।
৭. সৈয়দ শাহেদুল্লাহ্, শিক্ষা ও শ্রেণী সম্পর্ক, পৃ. ৯৪, সংস্কৃতি প্রকাশনী, ঢাকা।
৮. উদ্ধৃত, ঐ, পৃ. ৩১–৩২।
৯. বদরুদ্দীন উমর, প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার কয়েকটি দিক, ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, পৃ. ৭১, বইঘর, চট্টগ্রাম, ১৯৮০।
১০. Karl Marx, Critique of the Gotha Programme, p. 34, Marx-Engles Selected Works, Vol. II, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1962.
১১. বদরুদ্দীন উমর, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য, সংস্কৃতি, ডিসেম্বর ১৯৯৯।
১২. Karl Marx, Critique of the Gotha Programme, p. 24, Marx-Engles Selected Works, Vol. II, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1962.
১৩. Fredrick Engles, Anti-Duhring, p.130-131, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1962.
১৪. ঐ, p.130.
১৫. ঐ, p.131.
১৬. ঐ, p.132.
১৭. এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন বদরুদ্দীন উমর, শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এবং মাদ্রাসা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রসঙ্গে, সংস্কৃতি, এপ্রিল ১৯৯৯। আলী আনোয়ার, বাংলাদেশে ধর্ম শিক্ষা প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের শিক্ষা : অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, বাঙলাদেশ লেখক শিবির প্রকাশনা, ১৯৯০।
১৮. এ বিষয়ে দেখুন Ernest Mandel, Marxist Economic Theory, Merlin Press, pp. 337, 657.
১৯. সৈয়দ শাহেদুল্লাহ্, শিক্ষা ও শ্রেণী সম্পর্ক, পৃ. ৯৫, সংস্কৃতি প্রকাশনী, ঢাকা।
২০. Fredrick Engles, Anti-Duhring, p. Foreighn Language Publising House, Moscow, 1962. অনুবাদ: এ্যান্টি–ড্যুরিং–এর রাজনৈতিক অর্থনীতি খন্ড বাংলায় অনুবাদ করেন আনু মুহাম্মদ, ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে সংস্কৃতি।
২১. কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার, পোলীয় সংস্করণে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস–এর ভূমিকা, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো–এর অনুবাদ।
২২. সংবাদ প্রভাকর, ২০.৬.১৮৮২, উদ্ধৃতি, সৈয়দ শাহেদুল্লাহ, শিক্ষা ও শ্রেণী সম্পর্ক।
২৩. Karl Marx, Preface to the Critique of Political Economy, Selected Work, Vol I, p. 363, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1962).
২৪. ঐ, p. 363.
২৫. ঐ, p. 363.
২৬. Karl Marx, Critique of the Gotha Programme, p. 24, Marx-Engles Selected Works, Vol. II, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1962.
২৭. Lenin, Proletarian Revolution and Renegade Kautsky, p. 242, Lenin Collected Works, Vol. 28, Progress Publishers, Moscow.
——————————————
প্রথম প্রকাশ: সংস্কৃতি, জুলাই ২০০০
সংগ্রহ: মাসুদ রানা