লিখেছেন: শাহেরীন আরাফাত
অরুন্ধতী রায়– প্রতিরোধ, সংগ্রামের এক জীবন্ত প্রতিছবি। তাঁর সংগ্রাম একমুখী ছিল না। তাঁর রাজনৈতিক চেতনার বিকাশও সরলরৈখিক বা এক ঝটকায় আসেনি। অরুন্ধতীর সাহিত্য চর্চাও এই রাজনৈতিকতার বাইরে থাকেনি। চেতনাগত বিকাশের পর্যায়ে উপন্যাসের কথিত ছক ভেঙে সেখানে তিনি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে মেলে ধরেছেন। সামাজিক অব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের কথিত ‘সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের’ নামে অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম– অরুন্ধতী রায়কে রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টে পরিণত করে।
অরুন্ধতী রায় কালির অক্ষরে চালিয়ে যাচ্ছেন এক বন্ধুর সংগ্রাম। যেখানে জাতিগত, সম্প্রদায়গত, বা গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ন্যায়বিচারের দাবি করাটা তার রাজনৈতিক চিন্তা–চেতনারই অংশ। তিনি ভারতের বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে শাসন কাঠামো– বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আর এজন্য তার নিন্দুকেরও অভাব পড়েনি কখনও। তার বিরুদ্ধে আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ।
অরুন্ধতী রায় সম্ভবত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’–এর জন্যই সর্বাধিক পরিচিত। এতে তিনি জাতি–বর্ণ ব্যবস্থা, শ্রেণী ও ধর্মের সামাজিক অবস্থান নিপুণ কৌশলে তুলে ধরেছেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ওই উপন্যাসটির জন্য তিনি সেবছর বুকার পুরস্কার জেতেন।
অনলবর্ষী অরুন্ধতী রায়ের সংগ্রামের ক্ষেত্রটি কেবল উপন্যাসের মাঝেই সীমিত থাকেনি। তা অনেক বৃহৎ, আর তার পরিধিটুকু সম্ভবত প্রতিনিয়ত আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাতে যেমন এসেছে গান্ধী থেকে শুরু করে মোদি সরকারের সমালোচনা, তেমনি রয়েছে ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধ, এনজিও, কর্পোরেট পুঁজি থেকে শুরু করে আদিবাসী, মাওবাদী, কাশ্মীর, জেন্ডার ইস্যু, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন। সেই সঙ্গে রয়েছে জাতিসত্তার আন্দোলন, কাশ্মীর সংকট, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইস্যু। ভারতের জাতি–বর্ণ ব্যবস্থা, আম্বেদকার–গান্ধী প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা, এমনকি ভারতীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থাকেও যৌক্তিক সমালোচনায় প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তীক্ষ্ণ লেখনি এবং বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অরুন্ধতী তার ন্যায়বিচারের সংগ্রামকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ভারতে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির অভিযোগে বেশ কয়েকজন সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের পুরষ্কার ফিরিয়ে দেয়ার মিছিলে অরুন্ধতী রায়ও যোগ দেন।
সমাজ ও মানুষের বিভক্তি সম্পর্কে অরুন্ধতীর প্রাথমিক দৃষ্টিভঙ্গীটা ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছিলো। ছোটকাল থেকে অরুন্ধতী দেখেছেন জাতি–বর্ণ ব্যবস্থা কী করে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে, সেখান থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত হওয়া এবং প্রতিরোধের দ্রোহ প্রত্যক্ষ করেই গড়ে উঠেছে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা। যার সর্বশেষ প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় অরুন্ধতীর দ্বিতীয় উপন্যাসে– ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’।
তিনি বলেন, “একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত ভারতীয় মেয়েকে যে ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, আমার ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। আমাদের দেখাশোনা করার কথা বলে বিনিময়ে মাঝে মাঝে আমাদেরকে পেটানোর জন্য আমার কোনো বাবা ছিলো না। আমার ছিলো না কোনো জাত, শ্রেণী বা ধর্ম, চোখে ছিল না ঐতিহ্যের ঠুলি, চশমায় ছিল না ঐতিহ্যের কাঁচ, যেগুলো গা থেকে ঝেড়ে ফেলা সত্যিই কঠিন। সম্ভবত আমিই ভারতের একমাত্র মেয়ে, মা যাকে বলতেন, ‘আর যা–ই করো না কেন, কখনো বিয়ে করো না’। বিয়ের আনুষ্ঠানে কনে দেখলে আমার গায়ে যেন ফুসকুড়ি উঠতো। এটাকে আমার পৈশাচিকই মনে হতো। অলংকারসজ্জিত এই প্রাণীটিকে আমার জ্বলন্ত কাঠের মতো ভয়াবহ লাগতো, যেমনটা আমি আমার উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’–এ লিখেছিলাম।”
অরুন্ধতী বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ও লেখায় নিজের ছোটবেলা ও মায়ের স্মৃতিচারণ করেছেন। বলেছেন যে, ছোটবেলাতেই তিনি মায়ের কাছ থেকে স্বাবলম্বী হতে শিখেছিলেন। মা কখনো তাঁকে নিজের ‘দুর্ভাগ্যের’ জন্য দায়ী করতেন, আবার তিনিই মেয়েকে এই সমাজের বিরুদ্ধে, মানুষের পক্ষে লড়াইয়ের দীক্ষা দিতেন। মায়ের এই দ্বৈত আচরণ প্রথমদিকে তিনি বুঝতে পারতেন না। ধীরে ধীরে অরুন্ধতী মায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বগুলো বুঝতে পারেন। এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেন, “সমাজটাকে বোঝার ক্ষেত্রে আমার প্রথম শিক্ষক হলেন মা।”
অরুন্ধতী জানান, সামাজিক সমস্যা আর অসুস্থতার কারণে তাঁর মা সবসময়ই রাগান্বিত থাকতেন। যার প্রভাব পড়ে অরুন্ধতীর বেড়ে ওঠার সময়ে। তিনি বলেন, “মা সবসময়ই অসুস্থ থাকতেন, তাঁর শ্বাসকষ্ট ছিল। যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় তিনি থাকতেন আমার নানার বাড়িতে আর সবাই আমাদের সবসময় বলতো, তোমাদের এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই। মা ছিলেন রুক্ষ আর তিক্ত; আবার তিনিই ছিলেন সুন্দর আর কোমল। আমার মনে হয় যখন কেউ তাকে রাগিয়ে দিতেন, তখন সেই রাগটা তিনি একমাত্র আমার আর আমার ভাইয়ের ওপরই ঝাড়তে পারতেন, সেজন্যই আমাদের অনেক বকা খেতে হয়েছে।” লেখালেখির ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা অনেক কাজে লেগেছে অরুন্ধতীর। তার ভাষায়, “মা আমাকে ভেঙেছেন এবং গড়েছেন আবার ভেঙেছেন এবং গড়েছেন আবার ভেঙেছেন, গড়েছেন আর এখনো তা চলছে।”
২০০৭ সালে ‘দ্য প্রগ্রেসিভ’ ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় তার মায়ের সম্পর্কে বলেন, “তিনি ছিলেন ‘ফেলিনি’র সিনেমার বিপথগামী কোনো চরিত্রের মতো। পুরোপুরিই একরোখা ছিলেন। কখনো পুরুষ মানুষের প্রয়োজন হয়নি এমন একজন নারীকে দেখাও যে সম্ভব, তা এক অসাধারণ ব্যাপার। এভাবে যন্ত্রণা না পেয়ে বেঁচে থাকাটা সত্যিই আশ্চর্যের। আমরা অনেক উড়ো চিঠি পেতাম। আমার মা একটি স্কুল চালাতো, যা ছিলো দৃশ্যত সফল। লোকজন তাদের সন্তান জন্মাবার আগেই এই স্কুলে তাদের সন্তানদের নাম লিখিয়ে নিতো। তারা বুঝতে পারতো না আমার মাকে বা আমাকে নিয়ে কি করা যায়। আমরা দুজনই নারী এবং তাদের ভাষায় প্রথাবিরোধী, যা ছিলো প্রধান সমস্যা।
“…কেরালায় কিন্তু আমার মায়ের বেশ একটা পরিচিতি আছে। কারণ ১৯৮৬ সালে তিনি ভারতে প্রচলিত সিরীয় খ্রিষ্টান উত্তরাধিকার আইন সংশ্লিষ্ট জনগুরুত্বপূর্ণ একটি মামলা জিতেছিলেন। আগের আইন আনুযায়ী, নারীরা উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার সম্পত্তির চার ভাগের এক ভাগ অথবা পাঁচ হাজার রুপি (এ দুটির মধ্যে যেটির পরিমাণ কম সেটি) পেতেন। বস্তুত ১৯৫৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ের মাধ্যমে এই আইন বাতিল করে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর জন্য সমধিকার নিশ্চিত করে। কিন্তু খুব অল্প নারীই এই রায়ের সুবিধা নিতে পারে। চার্চগুলি এ বিষয়ে এতটাই তৎপর ছিলো যে। তারা পিতাদেরকে সম্পত্তি উইল করতে প্ররোচনা দিতো, যাতে কন্যাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায়।”
দুই.
সুজানা অরুন্ধতী রায় ১৯৬১ সালে উত্তরপূর্ব ভারতের ছোট্ট পাহাড়ি শহর শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা ম্যারির পরিবার কেরালার সিরীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁর বাবা রাজীব রায়ের পৈতৃক বাড়ি কলকাতায়। তিনি ছিলেন শিলংয়ের কাছে একটি চা বাগানের ম্যানেজার। মদ্যপ রাজীব রায়ের সঙ্গে ম্যারির বিয়েটি বেশিদিন টেকেনি। অরুন্ধতীর বয়স যখন দুই এবং তাঁর বড় ভাই ললিতের বয়স সাড়ে তিন, তখন তাঁর মা তাদের নিয়ে কেরালায় ফিরে আসেন। পরিবারে অনাকাঙ্খিত হওয়ায় তারা তামিল নাড়ুর ওটিতে অরুন্ধতী নানার মালিকানাধীন কটেজে চলে যান।
নিউইয়র্ক টাইমস–এর জন্য সিদ্ধার্থ দেবের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেন, “ওই সময়ের ঘটনাগুলো ছিলো ভয়াবহ… আমার মা ছিলেন খুবই অসুস্থ, মারাত্মক হাঁপানি রুগী। আমাদের মনে হতো তিনি মারা যাচ্ছেন। আমার মা আমাদের একটা ঝুড়ি দিয়ে বাজারে পাঠাতেন, দোকানদাররা ঝুড়িতে খাবার, মূলত চাল আর কাঁচা মরিচ দিতো।”
অরুন্ধতীর পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁরা ওটিতে ছিলেন। তাঁর নানি এবং মামারা তাদেরকে বাড়িটি থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়, আর সিরীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত উত্তরাধিকার আইনটি ব্যাপকভাবে পুরুষদের অনুকূলে। অরুন্ধতীর মা কেরালায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। সেখানে তিনি স্থানীয় রোটারি ক্লাব প্রাঙ্গনে একটি স্কুল চালু করেন। সিঙ্গেল মাদার–এর সন্তান হওয়ায় রক্ষণশীল সিরীয় খ্রিস্টান সমাজে অরুন্ধতী বেশ বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। খ্রিস্টান ও বর্ণ–হিন্দুদের তাচ্ছিলের শিকার হয়ে দলিতদের মধ্যে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতেন। অরুন্ধতীকে বিবেচনা করা হতো একটি ‘অসম্মানজনক’ বিয়ে এবং তার চেয়েও ‘লজ্জাজনক’ বিবাহ বিচ্ছেদের শিকার শিশু হিসেবে।
কেরালার অয়মানেমে কেটেছে অরুন্ধতীর শৈশব। সেখানকার বাস্তবচিত্র, বা বলা চলে তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহই ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’–এর মূল উপজীব্য। যেখানে ‘আম্মু’ শীর্ষক কেন্দ্রীয় চরিত্রটি তাঁর মায়ের জীবন দ্বারা প্রভাবিত। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা এবং পারিপার্শ্বিক পর্যবেক্ষণ থেকে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটির কাঠামো। যে কারণে তা একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠতে পেরেছে।
তখন কেরালায় ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট নামধারী সুবিধাবাদীরা। সমাজতন্ত্রের নাম জপলেও তাদের মধ্যে যে কী পরিমাণ ব্রাহ্মণ্যবাদ, তথা জাতি–বর্ণ ব্যবস্থা বিরাজমান ছিলো, তা অরুন্ধতীর লেখনিতে উঠে আসে। এজন্য কেউ কেউ অরুন্ধতীকে ‘কমিউনিস্ট বিদ্বেষী’ বলেও মূল্যায়ন করেছেন। ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসটি তিনি লেখা শুরু করেন ১৯৯২ সালে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত টানা লিখে গেছেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশের পর, সে বছরই এটি বুকার পুরস্কার জয় করে। বস্তুত, সে সময়কাল পর্যন্ত অরুন্ধতী কমিউনিস্ট বলতে ওই সংশোধনবাদীদেরই দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তিনি তাদের দ্বিচারিতা– মুখে সমাজতন্ত্রের কথা, কাজে ব্রাহ্মণ্যবাদিতা– নিয়ে আগে থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন।
উপন্যাসে দেখা যায়, হিন্দু বাঙালিকে বিয়ে করায় সিরীয় খ্রিষ্টান আম্মুকে পরিবার আপন করে নেয়নি। পরে আম্মু নিম্নবর্ণের ভেলুথার সঙ্গে প্রেম–যৌনতার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। দুই জমজের কাছেও ভেলুথা দেবতার চেয়ে কম কিছু ছিলো না। উপন্যাসের এক চরিত্র বামপন্থী নেতা কমরেড পিল্লাই, তার ছত্রছায়ায় আম্মুকে ভালোবাসার অপরাধে ভেলুথার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা দেওয়া হয়। থানায় নিয়ে রাতভর মারধরের পর ভেলুথার মৃত্যু হয়। অরুন্ধতী লিখেছেন, “ভেলুথা ছিল দুই জমজ আর তাদের মায়ের কাছে দেবতা। ছোট মানুষের দেবতা, ছোট দেবতা। বড় দেবতারা যখন হিংসায় আক্রোশে ছোট দেবতাকে মারতে আসে, তখন ছোট দেবতা সাধারণ মানুষ হয়ে যায়, রক্ত মাংসের মানুষ। তাঁর সম্মান মর্যাদার আর বালাই থাকে না।”
২০১৪ সালে আউটলুক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাবা নাকভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় বলেন, “আমার সমালোচনা হলো– কমিউনিস্টদের মূলধারা যেভাবে বর্ণব্যবস্থাকে মোকাবিলা করেছে, সেই পদ্ধতি নিয়ে– যা সর্বদা দ্য গড অফ স্মল থিংস–এর বিষয়ে ফিরে যাওয়ার দিকে নির্দেশ করে। ১৯৯৭ সালে যখন উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বইটির উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, কমরেড কে এন এম পিল্লাই নামে আমার রূপায়ণ করা একটা চরিত্র নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বইটিতে আরেক মূল চরিত্র একজন দলিত, ভেলুথার প্রতি কমরেড পিল্লাইয়ের কুসংস্কার দেখানো হয়েছিল। দলিত এবং কমিউনিস্টদের স্বাভাবিকভাবেই মিত্র হওয়াটা কর্তব্য, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাস্তবে সেটা হয়নি। ১৯২০–এর দশকের শেষদিকে প্রথম ফাটল দেখা দেয়, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্প সময় পরই। এস এ ডাঙ্গে একজন ব্রাক্ষ্মণের মতোই আচরণ করেন। আজকের দিনেও এমন কমিউনিস্ট নেতা দেখতে পাওয়া যায়, ডাঙ্গে যাদের মুখ্য তাত্ত্বিকদের অন্যতম। ৭০ হাজার সদস্য নিয়ে ভারতের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন, গিরনি কামগার ইউনিয়ন সংগঠিত করেন ডাঙ্গে। শ্রমিকদের একটা বড় অংশ ছিলেন অচ্ছুৎ মাহার, আম্বেদকার যে বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাদেরকে শুধুমাত্র স্পিনিং বিভাগের অল্প বেতনের কাজে নেওয়া হতো, কারণ উইভিং বিভাগের শ্রমিকদের মুখ দিয়ে সুতো চেপে রাখতে হতো, আর অচ্ছুৎদের লালা উৎপাদিত পণ্যের দূষণ ঘটাতে পারে বলে ধরে নেওয়া হতো। ১৯২৮ সালে ডাঙ্গে গিরনি কামগার ইউনিয়নের প্রথম বৃহৎ ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন। আম্বেদকারের প্রস্তাব ছিল একটা বিষয়কে সামনে তুলে ধরা যে, শ্রমিক পদমর্যাদার সকলের সমানতা ও সমান নামকরণ। ডাঙ্গে সহমত হননি, ফলে সে প্রচেষ্টা তিক্তভাবে ভেঙে পড়েছিল। তখন আম্বেদকার বলেছিলেন, ‘বর্ণ শুধুমাত্র শ্রমের বিভাজন নয়, এটা শ্রমিকদের মধ্যকার বিভাজন।’ …আমি কমিউনিস্ট নই। কিন্তু আমি মনে করি যে, আমাদের পুঁজিবাদের গঠনমূলক এবং শক্তসমর্থ সমালোচনা করা ভীষণ প্রয়োজন।”
অরুন্ধতী ২০১৪ সালে পুনরায় প্রকাশিত হওয়া ভীমরাও রামজী আম্বেদকারের ‘অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট– Annihilation of Caste (জাতি–বর্ণের নাশ)’ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেন। ‘দ্য ডক্টর অ্যান্ড দ্য সেইন্ট (The Doctor and The Saint- এক ডাক্তার আর এক সন্ন্যাসী)’ শীর্ষক অরুন্ধতী রায়ের ওই ভূমিকায় তিনি আম্বেদকার ও মোহনদাশ করমচাঁদ গান্ধীর তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরেন। গান্ধীর বিষয়ে প্রশ্ন তোলায়, তখনো শাসকশ্রেণীর মধ্যে যে কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী অরুন্ধতীর ছিলো, তারাও তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেন। ছোটকাল থেকেই জাতি–বর্ণের শোষণ প্রত্যক্ষ করা এই সাহিত্যিক জানান, ‘দ্য ডক্টর অ্যান্ড দ্য সেইন্ট’ লেখাটির জন্য তাকে গান্ধীর ৪৮ হাজার পৃষ্ঠার ৯৮ ভলিউমের পুরোটাই পড়তে হয়েছিল। আর এ সময়ে তিনি গান্ধীর সবিরোধিতা এবং সংস্কারের মধ্য দিয়ে তাঁর হিন্দুত্ববাদী ও বর্ণবাদী চর্চা দেখতে পান। অরুন্ধতী আরো জানান, এর আগে পর্যন্ত তিনিও আর দশজন ভারতীয়ের মতোই গান্ধীকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে বলেই মনে করতেন।
ওই ভূমিকায় অরুন্ধতী বলেন, “যারা সেই ইতিহাস ও তার নায়কদের সঙ্গে অপরিচিত, আম্বেদকার–গান্ধী বিতর্ক ঘুরপথে তাদের পৃথক রাজনৈতিক আবর্তে নিয়ে যেতে সক্ষম। এটি দুজন ভিন্নমতের মানুষের গভীর তাত্ত্বিক বিতর্ক ছাড়া আর কিছু নয়। দুজনেই দুটি ভিন্ন গোষ্ঠী স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতেন, আর ভারতের জাতীয় আন্দোলনের হৃদয়ে তাদের এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তারা যা বলেছিলেন এবং যা করেছিলেন, তা সমকালীন রাজনীতিতে অপরিমেয় তাৎপর্য বহন করে চলেছে। তাদের পার্থক্যগুলোর মধ্যে কোনো সন্ধি হওয়া সম্ভব ছিল না (এখনও সম্ভব নয়)। …আম্বেদকার ছিলেন গান্ধীর প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি তাকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেননি, নৈতিকতার প্রশ্নেও তা করেছিলেন। গান্ধীর গল্প থেকে আম্বেদকারকে বিচ্ছিন্ন করা– যে গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি, সেটা এক হাস্যকর বিকৃতি। একইভাবে আম্বেদকারকে নিয়ে লেখার সময় গান্ধীকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মানে হলো আম্বেদকারের অপকার করা, কারণ অবিস্ময়করভাবে আম্বেদকারকে বিবিধভাবে ঘিরে আছেন গান্ধী।”
উল্লেখ্য, আম্বেদকার ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল মধ্যভারতে অচ্ছুৎ মাহার সম্প্রদায়ের শকপাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আর দশজন অচ্ছুতের মতো তিনিও অল্প বয়সেই অস্পৃশ্যতার বিষে আক্রান্ত হন। স্কুলের বেঞ্চে বসার অনুমতিও তার ছিলো না। বাড়ি থেকে ‘কুরসি’ নিয়ে যেতে হতো। ক্লাসের এক কোণায় বসে পড়তে হতো। শিক্ষকরা তার বই–খাতা পর্যন্ত স্পর্শ করতো না। এমনকি পানি পানের পাত্রও তাকে নিয়ে আসতে হতো বাড়ি থেকে। অচ্ছুৎদের সংস্কৃত ভাষা শেখার অনুমতি না থাকায়, সেই ভাষাটিও তার শেখা হয়নি।
১৯১০ সালে আইএ এবং ১৯১২ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ পাশ করেন আম্বেদকার। তার পড়াশোনায় আর্থিক সহায়তা করেছিলেন বরোদার মহারাজা সায়াজিরাও গায়েকোয়াড়। মহারাজার সহায়তায় তিনি ১৯১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। সেখানে তিনি রাষ্ট্র বিজ্ঞান, দর্শন, নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির উপর পড়াশোনা করেন। ১৯১৫ সালে তিনি ‘প্রাচীন ভারতের ব্যবসা–বাণিজ্য’ বিষয়ে থিসিস জমা দেন এবং এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তীতে ‘ভারতের জাতীয় আয়– একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণমূলক সমীক্ষা’ শীর্ষক এক থিসিসের ভিত্তিতে আম্বেদকার পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৭ সালে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। বিদেশে পড়তে গিয়ে তিনি ভারতের বর্ণপ্রথার শোষণকে আরো কাছ থেকে বুঝতে সক্ষম হন। তবে ভারতের ফেরার পর তিনি দেখলেন জাতি–বর্ণ তার জন্য অপেক্ষারত। বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) শুধুমাত্র তার জন্মপরিচয়ের কারণে যথাযোগ্য জীবিকা পর্যন্ত পাচ্ছিলেন না। তীব্র অর্থ কষ্টেও তার চিন্তার বিকাশ থেমে থাকেনি। এ সময়ে তিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘রিকনস্ট্রাকশন অব সোসাইটি’ গ্রন্থের উপর সমালোচনামূলক প্রবন্ধ লিখেন। এটি ‘দ্য জার্নাল অফ দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনোমিক সোসাইটি’ পত্রিকায় ছাপা হয়। একই পত্রিকায় তার ‘ভারতে নিম্নবর্ণের সমস্যা ও তার প্রতিকারের উপায়’ লেখাটি ছাপা হয়। ওই সময়কালে তার ‘ভারতে বর্ণ–ব্যবস্থা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি বই আকারে প্রকাশিত হয়।
বোম্বের প্রাক্তন গভর্নর সিডেনহামের সুপারিশক্রমে তিনি সিডেনহাম কলেজ অব কমার্স এন্ড ইকোনোমিকসে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯২০ সালে আম্বেদকার উচ্চতর পড়াশোনার জন্য লন্ডনে যাত্রা করেন। ১৯২১ সালে তিনি লিখেন ‘ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্থনীতির প্রদেশভিত্তিক বণ্টন’। বিশ্ববিদ্যালয়ে এই থিসিস জমা দেওয়ার পর তিনি মাস্টার অফ সায়েন্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯২২ সালে তিনি লিখেন তার বিখ্যাত থিসিস ‘দ্য প্রব্লেম অব রুপি’। এতে তিনি দেখান, কিভাবে রুপি এবং পাউন্ডের সম্পর্ক ভারতের জনগণকে শোষণের নাগপাশে জড়িয়ে রেখেছে। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ততোদিনে আম্বেদকার অর্থনৈতিকভাবে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। ১৯২৩ সালে তাকে ফিরে আসতে হয় দেশে। তিনি আবারো থিসিসটি লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিলে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। এই লেখাগুলো আর জীবনের ঘটনাগুলোই ছিলো আম্বেদকারের চিন্তা কাঠামোর মূল ভিত্তি।
আম্বেদকারের প্রতিটা কথা, প্রতিটা অবস্থানই তার রাজনৈতিকতার পরিচায়ক। ১৯২০–এর দশকে তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে উঠা মুম্বাইয়ের সুতাকল শ্রমিকদের আন্দোলনেও তিনি যুক্ত হয়েছিলেন। দলিত এবং কমিউনিস্টদের মিত্রতাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সে সময়ের বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। অচ্ছুৎকে শুধুমাত্র স্পিনিং ডিপার্টমেন্টে অল্প বেতনের কাজে নেওয়া হতো, কারণ উইভিং মিলে শ্রমিকদের মুখ দিয়ে সুতা চেপে রাখতে হতো, আর অচ্ছুৎদের লালা মিশে থাকা সুতা দিয়ে উৎপাদিত পণ্য কিভাবে উচ্চবর্ণের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে! আর এ বর্ণবাদী সামন্তীয় প্রথার বিরুদ্ধেই ছিলো আম্বেদকারের অবস্থান। তবে শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গের মতো তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির আপোষকামী নেতারা তখন এ নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এর মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি সমাজের সবচেয়ে নিপীড়িত মানুষদের কাছে টানতে ব্যর্থ হয়। আম্বেদকার এজন্য ডাঙ্গেদের ব্রাহ্মণ্যবাদী আচরণকেই দায়ী করেন। উল্লেখ্য, পরবর্তী সময়ে চারু মজুমদারের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সিপিআই (এমএল) এবং তার ধারাবাহিকতায় এ সময়ে সিপিআই (মাওয়িস্ট) ওই নিপীড়িতদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজটা করে যাচ্ছে। অরুন্ধতী রায় বিভিন্ন সময়ে তাঁর লেখায় ও সাক্ষাৎকারে এ বিপ্লবী রাজনীতির পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থান জানিয়েছেন। বন্ধু পঙ্কজ মিশ্রর সঙ্গে এক কথোপকথনে অরুন্ধতী বলেছিলেন, মাঝে মাঝে তাঁর নিজেকে কমিউনিস্ট বলেই মনে হয়।
তিন.
গান্ধীর হিন্দুত্ববাদী–বর্ণবাদী চরিত্রও অরুন্ধতী রায়ের লেখায় ফুটে উঠেছে। গান্ধী একদিকে অচ্ছুৎদের দয়া দেখাতে বলতেন, আবার তাদের সঙ্গে যে কোনো সামাজিক সম্পর্কের বিরোধী ছিলেন। বিরলাদের মতো কর্পোরেট যেখানে তার আর্থিক সাহায্যকারী। গান্ধী পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে সমর্থন করতেন না, সাম্রাজ্যবাদের কথিত উন্নয়নের ধারণার বিরোধী ছিলেন। গ্রামভিত্তিক সমাজের কথা বললেও বর্ণভিত্তিক শ্রমের ধারণাকে তিনি সামনে এনেছিলেন। এমনকি দেশভাগের পর গান্ধী রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা নেই বলেও মত প্রকাশ করেন এবং জওহরলাল নেহেরুকে ভারতীয় কংগ্রেস ভেঙে দিতে বলেন। গান্ধীর সবিরোধী চরিত্রের বিষয়টিকে অল্প কথায় সুদৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছেন অরুন্ধতী।
দক্ষিণ আফ্রিকায় কংগ্রেসের নেতা হয়ে উঠা গান্ধী, সেখানে তাঁর চরম বর্ণবাদী অবস্থান স্পষ্ট করেন। তিনি ‘কাফির’–দের সঙ্গে একই পথ দিয়ে ডাকঘরে প্রবেশ করাকে পর্যন্ত স্বীকার করতেন না। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে এক কারাগারে অবস্থান করা বা সেখানে এক শৌচাগার ব্যবহার করতেও রাজি ছিলেন না।
অপরদিকে, আম্বেদকার ছিলেন এক যুক্তিবাদী মানুষ। যৌক্তিক বিচারে ভিন্নমত গ্রহণের মানসিকতাও ছিল তার। এজন্য তাকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখেননি অরুন্ধতী। বুর্জোয়া উদারতাবাদের প্রতি তীব্র আকর্ষণের ফলে সাম্রাজ্যবাদের কথিত উন্নয়ন দর্শনের প্রকৃত শোষণের রূপ আম্বেদকারের সামনে ফুটে উঠেনি। সেই সঙ্গে আদিবাসীদের প্রতিও তার অবস্থান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ভারতের সংবিধানে অচ্ছুৎদের খানিকটা অধিকারের কথা বলা হলেও, একই সময়ে আদিবাসী ও বিভিন্ন জাতিসত্তার অধিকার হরণও করা হয় ওই সংবিধানে। তবে এ নিয়ে সে সময়ে জোরালো বিতর্ক সামনে আসেনি। আম্বেদকারের সংগ্রামী জীবন থেকে অরুন্ধতী রায় সঠিকভাবেই সিদ্ধান্ত টেনেছেন, যুক্তি দিয়ে বিতর্ক উপস্থাপন করলে হয়তো আম্বেদকার এ বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতেন। যে মানুষটি ১৯৪৮ সালে সংবিধান সভার বৈঠকে বলতে পারেন, “ভারতীয় গণতন্ত্রের শুধু ঊর্ধ্বাংশ আবৃত, যা অবশ্যই অগণতান্ত্রিক”; তার কাছ থেকে এটুকু প্রত্যাশা করা যেতেই পারে!
আম্বেদকার হিন্দুত্ববাদের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো– এটা বুঝতে হবে যে, হিন্দু সমাজ বিষয়টা একটা মিথ। হিন্দু শব্দটাই একটা বিদেশি শব্দ। …হিন্দু সমাজ বাস্তবে নেই। এটা শুধু নানা বর্ণের সংকলন মাত্র।”
অরুন্ধতী ‘দ্য ডক্টর অ্যান্ড দ্য সেইন্ট’–এ লিখেছেন, “১৯২১ সালে নবজীবন–এ গান্ধী বর্ণ ব্যবস্থাকে অনুমোদন দেন। এটা গুজরাটি থেকে অনুবাদ করেন আম্বেদকার (যার মতে, গান্ধী একাধিকবার জনগণের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করেছেন, আর তাঁর ইংরেজি ও গুজরাটি লেখাগুলো থেকে এটি কার্যকরীভাবে মূল্যায়ন করা যায়)।
“‘জাতি–বর্ণের অন্য নাম হলো নিয়ন্ত্রণ। বর্ণ আনন্দের সীমারেখা টেনে দেয়। বর্ণ একজন ব্যক্তির আনন্দে রাশ টেনে ধরে এবং সীমানা পেরোতে দেয় না। এর অর্থ– এক বর্ণ পৃথক বর্ণের খাদ্যগ্রহণ, বিবাহ ইত্যাদির উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায়… এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, যারা বর্ণ ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চায়, আমি তাদের বিরোধী।’ (নবজীবন, গান্ধী)
“…জীবনের শেষ লগ্নে গান্ধী (তার দৃষ্টিভঙ্গি যখন দৃষ্টিভঙ্গিতেই আটকে ছিল, রাজনৈতিক কার্যকলাপে পরিণত হবার ঝুঁকি নিত না) বলেছিলেন, বিভিন্ন জাতের মধ্যে খাওয়াদাওয়া এবং বিয়ে নিয়ে তার আর তেমন আপত্তি নেই। কখনও কখনও তিনি বলতেন, যদিও তিনি বর্ণব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন, একজন মানুষের বর্ণ তার কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে ঠিক হওয়া উচিত, জন্মের নিরিখে নয় (এটা আর্য সমাজেরও অবস্থান ছিল)। আম্বেদকার এই ধারণার অযৌক্তিকতাকে চিহ্নিত করেন– ‘যারা জন্মের নিরিখে উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন, তাদের গুরুত্ব আরোপ না করে, কিভাবে আপনি তাদের মর্যাদা ছেড়ে দিতে বাধ্য করবেন? যারা জন্মের ভিত্তিতে নিম্ন মর্যাদায় পড়ে রয়েছে, কিভাবে আপনি সেই মানুষগুলোকে চিনতে বাধ্য করবেন যে, একজন মানুষের নৈতিক গুণ অনুযায়ী তার মর্যাদা চিহ্নিত হওয়া উচিত?’ তিনি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন, নারীদের ক্ষেত্রে কি হবে– হয় তাদের যোগ্যতার ভিত্তিতে অথবা তাদের স্বামীদের যোগ্যতার ভিত্তিতে মর্যাদা নির্ধারিত হবে।
“…গান্ধী একজন অসাধারণ এবং আকর্ষণীয় মানুষ এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি কি সত্যিই সত্যের শক্তির কথা বলেছিলেন? তার সবচাইতে অরক্ষিত দেশবাসী– দরিদ্রের মধ্যে যারা দরিদ্রতম, তিনি কি সত্যিই তাদের বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন?
“‘যেহেতু কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, সুতরাং তারা লড়ছে আপামর ভারতবাসীর জন্য এবং নীচুদের মধ্যে নিম্নতর মানুষদের জন্য। এ ধরণের প্রবোধ বাক্য বোকামি ছাড়া কিছু নয়।” আম্বেদকার আরো বলেন, “কংগ্রেস স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে, এই প্রশ্নটা খুব কম গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটার কাছে যে, কংগ্রেস কাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে।’
“১৯৩১ সালে আম্বেদকার যখন প্রথমবার গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন, কংগ্রেস সম্পর্কে তার তীক্ষ্ণ সমালোচনার বিষয়ে গান্ধী তাকে জিজ্ঞাসা করেন, আম্বেদকার উত্তরে বলেছিলেন, ‘গান্ধীজী, আমার কোনো স্বদেশ নাই। কোনো অচ্ছুৎ এই ভূমির জন্য গর্ববোধ করবে না।’”
হিন্দুত্ববাদ চর্চায় গান্ধী ও নেরেন্দ্র মোদির সাদৃশ্য তুলে ধরে সাবা নাকভীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় বলেন, “নরেন্দ্র মোদি তার হিংস্র বক্তব্যগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই রেখেছেন, গুজরাটের নতুন কনভেনশন হলে, যার নাম মহাত্মা মন্দির। ১৯৩৬ সালে গান্ধী The Ideal Bhangi নামে একটি অসামান্য প্রবন্ধ লেখেন, যেখানে তিনি এটা বলে শেষ করেছেন যে– “একজন আদর্শ ভাঙ্গি যখন কাজ থেকে তার জীবিকা আহরণ করে, সেটা সংগ্রহ করাকেই একমাত্র পবিত্র কাজ মনে করে। সে সম্পদ জমানোর স্বপ্ন দেখতে পারে না।” সত্তর বছর পর তার কর্মযোগী বইয়ে (পরবর্তীতে, বাল্মিকী সম্প্রদায় প্রতিবাদ করলে, তিনি তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন) নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, “আমি বিশ্বাস করি না যে, তারা শুধু জীবিকার জন্যই কাজ করেন। যদি তাই হতো তাহলে, তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একই ধরণের কাজ চালু রাখতো না। কোনো না কোনো সময়, কেউ না কেউ আলোকপ্রাপ্ত হবে, তাদের (বাল্মিকীদের) কর্তব্য হলো, ঈশ্বর ও সমস্ত সমাজের জন্য সুখ নিয়ে আসা; তাদের এই কাজটা করতে হবে, যা ঈশ্বর তাদের ওপর অর্পণ করেছেন; আর এই কাজগুলোকে এগিয়ে চলতে হবে, শতকের পর শতক জুড়ে অভ্যন্তরীণ আধ্যাত্মিক ক্রিয়াকলাপকে জারি রাখার জন্য।” আপনি আমায় বলুন– তাদের বক্তব্যে পার্থক্য কোথায়?”
ভারতের জাতি–বর্ণ ব্যবস্থা তার আর্থ–সামাজিক কাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভারতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না হওয়ায় তার মধ্যকার জাতি–বর্ণ ব্যবস্থাও বিলুপ্ত হয়নি। বরং তা বিবিধ সংস্কারের মধ্য দিয়ে নিজের মৌলিকত্ব ধরে রেখেছে। কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির মতো ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে চালিত রাজনৈতিক দলগুলো হিন্দু সংস্কারকদের ধাঁচেই ‘নরম হিন্দুত্ববাদের’ চর্চা জারি রেখেছে। সমাজের মৌলিক পরিবর্তন তাদের ধাঁতে নেই। অপরদিকে রয়েছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস), হিন্দু মহাসভা, বিজেপি, শিবসেনা, বজরঙ দল ইত্যাদি– যা হিন্দুত্ববাদের আগুনে তপ্ত।
হিন্দুত্ববাদের উত্থান সম্পর্কে কিছু বলার আগে হিন্দুত্ববাদ সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি। হিন্দুত্ববাদ হলো– চতুর্বর্ণ–ভিত্তিক এক ব্যবস্থা। যেখানে অর্থনৈতিক সংস্থানও বর্ণাশ্রম নির্ভর। আবার তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কর্পোরেট অর্থনীতি। এই তত্ত্বানুসারে, ভারতীয় উপমহাদেশকে হিন্দুদের স্বদেশ বলে উল্লেখ করা হয়। আর সেই সঙ্গে হিন্দুত্ববাদ ধর্মের ভিত্তিতে জাতি গঠনের প্রশ্নটিকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং নিম্নবর্ণের উপর আধিপত্য কায়েম করাটা হিন্দুত্ববাদের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তবে সেখানে সর্বাগ্রে স্থান পায় কর্পোরেট স্বার্থ। এটি ওয়াহাবিবাদ বা জায়নবাদের মতোই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের একটি রূপ।
বস্তুতপক্ষে ‘হিন্দুধর্ম’ আর ‘হিন্দুত্ব’ দুটোকে এক করে দেখার অবকাশ নেই। হিন্দুধর্ম– যার মধ্যে বহু ধরনের দার্শনিক চিন্তা এবং অনুশীলনের সংমিশ্রণ ঘটেছে, যার একটা বহুমাত্রিক চরিত্র আছে, তাকে অস্বীকার করে হিন্দুধর্মকে এক যান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হিন্দুত্ববাদীরা আর্যতত্ত্বকেই বারবার সামনে তুলে ধরে। তাদের এই বিভ্রান্তিকর ফ্যাসিবাদী ধারণার অসারতাকে বুঝতে গেলে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণরূপ আজও প্রকাশিত হয়নি। তবে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা কিছু সিদ্ধান্ত টানতে সক্ষম হয়েছেন–
১) ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর–পশ্চিম অঞ্চল থেকে মধ্যভারতের উত্তরভাগ পর্যন্ত যে জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, সেই প্রাগার্য মানুষেরাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা।
২) এই সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত অধুনা বালুচিস্তান, আফগানিস্তান, সিন্ধু, পঞ্জাব, গুজরাট, রাজস্থানের কিছু অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, লোথাল, কালিবঙ্গান ইত্যাদি ছিল এই সভ্যতার সময়কার বড় বড় নগরী।
৩) প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বলছে, প্রাগার্য এই সভ্যতা ছিল সময়ের হিসেবে যথেষ্ট বিকশিত। সেখানকার রাস্তাঘাট ছিল যথেষ্ট চওড়া, এছাড়া প্রাসাদ, দুর্গ, স্নানাগার, নদীবাঁধ, বাড়ির বারান্দা, সেসব সেই যুগেও ছিল। আর ছিল উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার নিদর্শন। সেখানে শস্যভাণ্ডারেরও চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে কোনো অস্ত্রভাণ্ডার পাওয়া যায়নি। এসব থেকে অনুমান করা হয় যে, তৎকালীন সময়ে সেখানকার সাধারণের স্বাস্থ্য ও খাদ্যব্যবস্থা বেশ ভালোই ছিল। সমাজব্যবস্থা ছিলো সম্ভবত কেন্দ্রশাসিত। হয়তো পুরোহিত–শাসিত ব্যবস্থা ছিল এবং জীবনযাপন ছিল শান্তিপূর্ণ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু উন্নতমানের রঙিন চিত্র করা মৃৎশিল্প। এই সভ্যতার সময়কার যে ওজনের বাটখারাগুলো পাওয়া গেছে, সেগুলো পর্যন্ত সর্বত্র সমওজনের ছিল! সিন্ধু সভ্যতার মানুষ লিখতে পড়তে জানত, সিলমোহরের উপর লেখায় তার প্রমাণ রয়েছে। যদিও আজ অবধি সেই লিপির অর্থ উদ্ধার করা যায়নি।
৪) ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা হলো– একটা যোগীমূর্তি পাওয়া গেছে যাকে ঘিরে আছে হাতি, গন্ডার, বাঘ ও ষাঁড়ের দল। মূর্তিটিকে ইতিহাস বিশেষজ্ঞরা শিবের মূর্তি বলে মত প্রকাশ করেছেন। সিন্ধু সভ্যতার নারীমূর্তিগুলো থেকে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন যে, সে সময় ধর্মবিশ্বাস ছিল দেবীপ্রধান বা মাতৃপ্রধান, যেখানে বৈদিক ধর্মবিশ্বাস ছিল পুরুষপ্রধান। ঋগ্বৈদিক সাহিত্যে দেখা যায় যে, ইন্দ্র ঊষাকে আক্রমণ ও বিধ্বস্ত করেছেন। অনুমান করা হয় যে ঊষা হলেন প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতারই মাতৃদেবী। এখানে সম্ভবত বোঝানো হয়েছে, নারীপ্রধান সিন্ধু সভ্যতাকে বিধ্বস্ত করেছে পুরুষপ্রধান আর্যসভ্যতা। বৈদিক কবিদের কল্পনায় তাই ইন্দ্রের আক্রমণে বিপর্যস্ত ঊষার শকট ধ্বস্ত হচ্ছে এবং ভীত ঊষা বিপাশার তীর ধরে পলায়ন করছেন। এর অর্থ হলো, পিতৃপূজায় বিশ্বাসীদের অর্থাৎ আর্যদের আক্রমণে মাতৃপূজায় বিশ্বাসী অনার্য সভ্যতা বিপর্যস্ত হচ্ছে। এছাড়াও সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে, উদ্ভিদ–পরিবৃতা দেবীমূর্তির খোঁজ মিলেছে, অনুমান করা হয়, ইনি হলেন শস্যের দেবী। সিন্ধু সভ্যতায় নারীপুরুষের যোনি ও লিঙ্গের মূর্তিও পাওয়া গেছে। এই লিঙ্গমূর্তি তথা শিশ্নদেব আবার ঋগ্বেদে ধিকৃত হয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে ঋগ্বেদ থেকেই উদ্ধৃত করা যেতে পারে– “সেই প্রভু ইন্দ্র বিষম প্রাণীর শাসনে যেন আমাদিগকে উৎসাহ দেন এবং শিশ্নদেবগণ যেন আমাদের ঋতকে পরাজিত না করে।” আরেক জায়গায় বলা হয়েছে– “অন্নের প্রাপয়িতা (ইন্দ্র) শত্রুদের ধন বিভাগ করিতে ইচ্ছুক হইয়া দুষ্ট পতন হইতে রক্ষার্থে নিকটে বসিয়া আছেন; সংগ্রামে বলপূর্বক শিশ্নদেবগণকে হত্যা করিতে করিতে (তিনি) শতদ্বার–বিশিষ্ট ধন (শত–দূরস্য বেদঃ) অভিভূত করেন।”
যোগসাধনাও ছিলো অবৈদিক সাধন পদ্ধতি। সিন্ধু সভ্যতার শিব ও অন্যান্য যোগীমূর্তির প্রত্ন নিদর্শন থেকে অনুমান করা যায়, তখন যোগ সাধনার প্রচলন ছিল। কৌষীতকি উপনিষদে আর্যদের প্রধান দেবতা ইন্দ্র আস্ফালন করছেন, “আমি ত্রিশীর্ষ ত্বষ্টৃপুত্রকে হত্যা করেছি; আমি অরুন্মুখ যতিগণকে সালাবৃকগণের মুখে অর্পণ করেছি।” এখানে ‘ত্রিশীর্ষক’ হচ্ছে তিনটি শিংবিশিষ্ট। যেরকম মূর্তিকে জন মার্শালের মতো ইতিহাসবিদরা শিবের মূর্তি বলে অভিহিত করেছেন। ‘যতি’ অর্থে যোগী, যাকে সালাবৃকগণের অর্থাৎ হায়না বা নেকড়ে জাতীয় প্রাণীর মুখে তুলে দিয়েছিলেন ইন্দ্র। মুণ্ডকোপনিষদ বা গীতায় স্পষ্টভাবেই এই ‘যতি’দের যোগী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ‘যতি’ তথা যোগীদের হায়না বা নেকড়ের মুখে তুলে দেওয়ার উল্লেখ শুধু কৌষীতকি উপনিষদেই উল্লেখ করা হয়নি, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় সংহিতা, শতপথ ব্রাহ্মণ এবং জৈমিনীয় ব্রাহ্মণেও তার উল্লেখ রয়েছে। এই উদাহরণগুলো দুটো জিনিসকে সামনে আনছে– প্রথমত, এগুলোর মধ্যে দিয়ে আর্য এবং সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী তথা অনার্যদের সংঘাতগুলো ফুটে উঠছে। দ্বিতীয়ত, শিশ্নদেব বা ত্রিশীর্ষক অর্থাৎ শিবকে পরাস্ত করা কিংবা যতিদের হত্যা করা এবং ঊষাকে পরাস্ত করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে একটা কথা প্রমাণ হচ্ছে এই সমস্ত দেব–দেবীর ধারণাই আর্য–পূর্ববর্তী। অবৈদিক এসব দেব–দেবী এবং অবৈদিক উপাচার, সাধনপদ্ধতিকে আর্যরা মেনে নিতে না পারায় এই সংঘাতের জন্ম।
৫) সিন্ধু সভ্যতার সময়কার সিলমোহরগুলো দেখে অনুমান করা হয় যে, ওই সময় বাণিজ্যের প্রচলন ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের ধারণা, মিশর ও সুমেরীয়দের সঙ্গে নৌপথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
৬) তৎকালীন সমাজে মৃতদেহ দাহ করার এবং সমাহিত করার– দুধরনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ারই প্রচলন ছিল। ঐতিহাসিকদের ধারণা, এই সমাজ অন্তত এক হাজার বছর টিকে ছিল।
৭) আর্যসভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার একটা বৈশিষ্ট্যসূচক পার্থক্য হলো– আর্যসভ্যতার মতো এই সভ্যতায় ঘোড়া বা ঘোড়া চালিত রথের ব্যবহার দেখা যায় না। চাকার ব্যবহার ছিল, কিন্তু চাকায় স্পোকের ব্যবহার দেখা যায়নি, আর্যসভ্যতায় যা দেখা গেছে। এছাড়া সিন্ধু সভ্যতার মানুষ লিপির আবিষ্কার করেছিল। তারা লিপির ব্যবহার জানত। প্রত্নতত্ত্ববিদরা যদিও সেই লিপির মানে উদ্ধার করতে পারেনি কিন্তু আর্যরা লিপির ব্যবহার জানত না, তাই বেদের কোনো লিখিত রূপ ছিল না। আমরা জানি মুখে মুখে প্রচারিত হত বলেই বেদের অপর নাম ‘শ্রুতি’।
৮) সিন্ধু সভ্যতার সমাজে ব্রোঞ্জের যুগের নাগরিক সংস্কৃতি বিরাজমান ছিলো বলে ধারণা করা হয়। কৃষির ব্যবহার তো তারা জানেতেনই, পাশাপাশি পশুপালন এবং মৃগয়া করা ছাড়াও ধাতুবিদ্যা এবং বয়নশিল্পও যেমন তাদের জানা ছিল, তেমনই তারা অলঙ্কারের প্রয়োজনে বহুমূল্য পাথর খোদাইয়ের কাজও করতে পারতেন। সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর ‘ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য’ গ্রন্থের মুখবন্ধে দাবি করেছেন যে, এই প্রাগার্য সভ্যতার অধিবাসীরা তুলা চাষ করে সুমেরীয়দের কাছে বিক্রি করতো, এমন প্রমাণও পাওয়া গেছে। তবে এই সভ্যতার মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি। সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে কৃষিকাজের চল ছিল। আর তার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল এক নাগরিক সভ্যতা। সেখানে দেখা মেলে এক বিরাট শস্যভাণ্ডার বা গোলাঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের। চার্বাক দর্শন, জৈন বা বৌদ্ধ দর্শনের মতো পরবর্তী ভারতীয় দর্শনসমূহেও এই সমৃদ্ধ সভ্যতার সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
৯) সিন্ধু সভ্যতা নিশ্চিতভাবেই ছিল আর্য–পূর্ব সভ্যতা, কেননা সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কৃষির উপর ভিত্তি করে, কৃষির বিকাশ ছাড়া এতো বড় নগর সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব ছিলো না। এর বিপরীতে বৈদিক সভ্যতা ছিল প্রথমাবস্থায় পশুপালন নির্ভর, বৈদিক সাহিত্যেই তার প্রমাণ আছে। যে কারণে বৈদিক যুগে কোনো নগর সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, একটিমাত্র প্রকটভাবে অর্বাচীন সূক্ত ছাড়া ঋগ্বেদের দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডলের কোথাও জমিতে লাঙলের উল্লেখ পর্যন্ত নেই। তিনি বলেন, “বৈদিক ও প্রাক্বৈদিক সংস্কৃতির মূলে এই অর্থনৈতিক পার্থক্যের কথা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা সংস্কৃতির সত্তা নিরালম্ব নয়; শেষ পর্যন্ত তা অর্থনৈতিক জীবনের উপর নির্ভরশীল।” তিনি আরও বলেন, “সিন্ধু–যুগেই এ সভ্যতা সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় সভ্যতার রূপ গ্রহণ করেছে এবং ওই সিন্ধু সভ্যতাই আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতির প্রধান ভিত্তি। কেননা, নির্মাণ কৌশল, কারুশিল্প এবং বিশেষ করে বেশভূষা এবং ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে– মোহেনজোদাড়োর আবিষ্কৃত বৈশিষ্ট্যগুলোই সমগ্র ঐতিহাসিক যুগ ধরে ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য হয়ে থেকেছে।”
হিন্দুত্ববাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচিত হয় বিনায়ক দামোদর সাভারকরের হাত ধরে। প্রথম জীবনে সাভারকর দেশের মুক্তির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। তিনি ‘ইন্ডিয়া হাউস’ নামক একটি বিপ্লবী সংস্থায় যোগদান করেন। বিপ্লবী জীবনে তিনি ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে ‘ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ নামে একটি বইও প্রকাশ করেন, যে বইয়ে ‘বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের’ কথা বলা হয়েছিল। বইটি ব্রিটিশরা নিষিদ্ধ করেছিল। ১৯১০ সালে ‘ইন্ডিয়া হাউস’–এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় তিনি দুবার পালানোর চেষ্টা করেন। পলায়ন চেষ্টার অভিযোগে তাকে ৫০ বছর কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে ১৯২১ সালে, অর্থাৎ ১০ বছরের মধ্যেই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ওই বছরই তিনি তার বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত ‘হিন্দুত্ভ : হু ইজ্ হিন্দু’ বইটি প্রকাশ করেন। কেন হঠাৎ করে সাজার মেয়াদ ফুরোনোর আগেই তাকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হলো? এর পেছনের একটি ইতিহাসও পরে জনসমক্ষে আসে। ২০০২ সালের ৪ মে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র কলকাতা সংস্করণে একটি চাঞ্চল্যকর খবর ফাঁস হয়ে যায়। শিরোনাম ছিল, ‘হিন্দুতভ্ হিরো সাভারকর হ্যাড বেগড্ ব্রিটিশ ফর মার্সি’। খবরটিতে ব্রিটিশের কাছে করুণা ভিক্ষা করে সাভারকরের লেখা একটি চিঠি প্রকাশ করা হয়। মহাফেজখানা থেকে উদ্ধার হওয়া এই চিঠিটি প্রথম প্রকাশিত হয় কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রণালয়ের গেজেটিয়ার ইউনিটের ‘পেনাল সেটেল্মেন্ট ইন আন্দামান’ নামক একটি বইয়ে। চিঠিটিতে তারিখ হিসেবে ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বরের উল্লেখ আছে।
সাভারকর লিখেছেন, “যদি সরকার তার বহুবিধ বদান্যতা আর করুণার বশবর্তী হয়ে আমাকে মুক্তি দেন, আমি সংবিধানসম্মত প্রগতি এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্যের সবচেয়ে একনিষ্ঠ না হয়ে পারি না। …তাছাড়া সাংবিধানিক পথে আমার এই পরিবর্তন ভারত ও তার বাইরে থাকা বিপথগামী তরুণদের ফিরিয়ে নিয়ে আসবে যারা এক সময় আমাকে তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে ভেবেছিল। সরকার যেমন চাইবে, আমি তেমন সেবা করতে প্রস্তুত, কারণ বিবেকের তাড়নায় আমার পরিবর্তন বলে আমি আশা রাখি, আমার ভবিষ্যতের ব্যবহারও অনুরূপ হবে। …মহান রাজন ছাড়া কেই বা করুণাময় হতে পারেন; আর সরকারের পৈতৃক আবাসে ফিরে যাওয়া ছাড়া উড়নচণ্ডে সন্তান আর কী বা করতে পারে।”
সে বছরই সাভারকর লিখেন তার ‘হিন্দুত্ভ : হু ইজ্ হিন্দু’ নামক সেই কুখ্যাত গ্রন্থ। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ফেরিওয়ালাদের কাছে যে বইটি শ্রীমদ্ভাগবত গীতার চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। সাভারকর সেখানে ‘হিন্দু জাতি’ সম্পর্কিত এক উদ্ভট ধারণাকে সামনে আনেন। যা আদতে উপমহাদেশে প্রথম দ্বিজাতি তত্ত্বের জন্ম দেয়। সাভারকরের মতে, হিন্দু জাতির প্রতিনিধি হলো তারাই, যারা এদেশকে শুধু ‘পিতৃভূমি’ বা ‘মাতৃভূমি’ বা ‘জন্মভূমি’ বলে স্বীকার করেই ক্ষান্ত থাকেন না, পাশাপাশি এদেশকে ‘পবিত্রভূমি’ তথা ‘পূণ্যভূমি’ হিসেবেও স্বীকার করেন। তার মতে, এই জাতি হলো একমাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারতবাসীরাই, কারণ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে এদেশটা ‘পিতৃভূমি’ বা ‘মাতৃভূমি’ বা ‘জন্মভূমি’ হলেও তারা এদেশটাকে ‘পূণ্যভূমি’ বলে মনে করেন না। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, যেসব খ্রিস্টান বা মুসলমান এদেশে জন্মেছেন, তাদের কাছে এদেশটা জন্মভূমি হলেও তারা এদেশকে ‘পূণ্যভূমি’ মনে করেন না। খ্রিস্টানদের কাছে ‘পবিত্রভূমি’ হলো ফিলিস্তিন তথা জেরুজালেম। আর মুসলমানদের ‘পবিত্রভূমি’ হলো মক্কা তথা আরব। একমাত্র হিন্দুরাই এদেশটাকে ‘পবিত্রভূমি’ তথা ‘পুণ্যভূমি’ মনে করেন, অতএব এদেশটা তাদেরই। এভাবে সাভারকর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির তাত্ত্বিক ভিত রচনা করার মধ্যে দিয়ে ইংরেজ সরকারের প্রতি তার ‘আনুগত্যের একনিষ্ঠতা’ দেখালেন। বইটি এদেশে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের মধ্যে প্রবল আলোড়ন ফেলে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ঘোষিত সাংগঠনিক নীতি হলো– একচালক অনুবর্তিতা, অর্থাৎ একজন নেতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। সংগঠনের সেই একক ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে তারা বলেন ‘সরসংঘচালক’। আরএসএস–এর ঘোষিত লক্ষ্য হলো– ‘হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান’। সাভারকর স্লোগান তুলেন, ‘রাজনীতির হিন্দুত্বকরণ এবং হিন্দুত্বের সামরিকীকরণ’–এর। সংঘ পরিবারের মতে, ‘হিন্দু জাতির’ সংস্কৃতিই হলো– এদেশের ‘জাতীয় সংস্কৃতি’। আরএসএস–এর হিন্দু জাতীয়তাবাদ খোলাখুলিভাবেই ‘হিন্দি–হিন্দু–হিন্দুস্তান’–এর কথা বলে, তেমনই পাশাপাশি তা উচ্চবর্ণের আধিপত্যবাদেরও সমর্থক।
আরএসএস–এর গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হলো– ভিন্নধর্মের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন মানসিকতা গড়ে তোলা, বিশেষত মুসলমান বিরোধিতা। আরএসএস–এর ঘনিষ্ঠ সংগঠন হিন্দু মহাসভা। প্রসঙ্গত, ১৯৫০ সালেই হিন্দু মহাসভার সাধারণ সম্পাদক মহান্ত দিগ্বিজয় নাথ ঘোষণা করেন– “হিন্দু মহাসভা যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে পাঁচ থেকে সাত বছরের জন্য মুসলমানদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। তারা যে ভারতীয় স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করতে চায়, এটা বুঝতে সরকারের ওই সময় লাগবে।”
অরুন্ধতী বলেন, “সংস্কারকরা ‘হিন্দু’ ও ‘হিন্দুত্ব’ শব্দগুলি নতুনভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেন। তার আগে পর্যন্ত এই শব্দগুলি ব্রিটিশ এবং মুঘলরা ব্যবহার করতো, কিন্তু যারা হিন্দু বলে পরিচিত ছিলেন, তারা কখনও নিজেদের বর্ণনা এই শব্দগুলির দ্বারা দিতেন না। জনসংখ্যা নিয়ে আতঙ্কিত হবার আগে পর্যন্ত, তারা নিজেদের জাতপাত, নিজেদের বর্ণের পরিচয়কেই সামনে রাখতেন। আম্বেদকার বলেছিলেন, ‘প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো– এটা বুঝতে হবে যে, হিন্দু সমাজ বিষয়টা একটা মিথ। হিন্দু শব্দটাই একটা বিদেশি শব্দ। …নিজেদের সিন্ধু নদীর পূর্ব তীরের অধিবাসীদের থেকে আলাদা করবার জন্য মুসলমানরা এই নাম দিয়েছিলেন। মুসলমান আক্রমণের আগে সংস্কৃতে এমন কোনো শব্দ ছিল না। তারা কোনো সাধারণ নামের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি, কারণ তারা কোনো একই সম্প্রদায়ের অংশীদার, এমন ধারণা তাদের মাঝে ছিল না। হিন্দু সমাজ বাস্তবে নেই। এটা শুধু নানা বর্ণের সংকলন মাত্র।’
“যখন থেকে সংস্কারকরা নিজেদের এবং নিজেদের সংগঠনগুলির ক্ষেত্রে ‘হিন্দু’ শব্দটা ব্যবহার করতে শুরু করেন, তখন তাতে ধর্মের প্রশ্ন কম ছিল, বরং বহুভাগে বিভক্ত মানুষকে ধাপ্পা দিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংবিধান রচনা করাটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এ থেকে বোঝা যায়, কেন সংস্কারকরা বারবার ‘হিন্দু জাতি’ বা ‘হিন্দু বর্ণের’ প্রসঙ্গ আনতেন। রাজনৈতিক হিন্দু ধর্মই পরবর্তীকালে হিন্দুত্ববাদ হিসেবে ওঠে আসে।”
উল্লেখ্য, ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দের মানে হলো রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে (রিলিজিয়ন অর্থে) পৃথক রাখা। রাষ্ট্রীয়, সরকারি এবং সর্বজনীন কর্মপরিচালনা থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন রাখা। কোনো গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এটি অপরিহার্য। সেই সঙ্গে প্রতিটা নাগরিকের ধর্ম চর্চা করার বা না করার অধিকার নিশ্চিত করাটাও ওই গণতান্ত্রিক কাঠামোরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ভারত তার জন্মলগ্ন থেকেই সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করে এসেছে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী থেকে ধর্মকে পৃথক রাখার পক্ষে মত দেন। হিন্দু মহাসভার বাড়বাড়ন্ত রূপকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি। আর এক্ষেত্রে গান্ধীর সঙ্গে নেহেরুর চিন্তার সুস্পষ্ট পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। তিনি বলেন, “ধর্ম বলতে যে ব্যাপার স্যাপারগুলোকে ভারতে কিংবা অন্যত্র বোঝানো হয়, তার ভয়াবহতা দেখে আমি শঙ্কিত এবং আমি সবসময়ই তা সোচ্চারে ঘোষণা করেছি। শুধু তাই নয়, আমার সবসময়ই মনে হয়েছে এ জঞ্জাল সাফ করে ফেলাই ভাল। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধর্ম দাঁড়ায় ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, মূর্খতা, কুসংস্কার আর বিশেষ মহলের ইচ্ছার প্রতিভূ হিসেবে।” তবে নেহেরু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ধর্মবাদীগোষ্ঠীর চাপে এই সেক্যুলারিজমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে ব্যর্থ হন।
ভারতের সাংবিধানিক সেক্যুলারিজমের অন্তর্নিহিত অর্থ প্রকাশিত হয় ভারতের প্রথম হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রপতি এস. রাধাকৃষ্ণনের বক্তব্যে। তিনি ১৯২৯ সালে প্রকাশিত An Idealist View of Life গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়’। তার মতে, “ভারতের সেক্যুলারিজম পাশ্চাত্য থেকে ভিন্ন। এখানে সেক্যুলারিজমের মানে হলো সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা এবং তা কখনোই ধর্মহীন নয়।” রাধাকৃষ্ণন ওই গ্রন্থে হিন্দুত্ববাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন এবং উদাহরণ হিসেবে শংকরাচার্যের কথা যেমন উল্লেখ করেন, তেমনি গান্ধীকেও উল্লেখ করেন। এই রাজনৈতিক ভণ্ডামোর সুযোগ নিয়েছে এবং নিচ্ছে ডান–বাম নির্বিশেষে ভারতের শাসকশ্রেণীর সবগুলো রাজনৈতিক দল। কংগ্রেস এই সেক্যুলারিজমের নামে ধর্মকে ব্যবহার করেছে ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য। একইভাবে আরএসএস এই ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় তৎপর থেকেছে।
সেক্যুলারিজমকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’ বলার মধ্য দিয়ে কীভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে আধিপত্যের স্থানে আসীন করা হয়, সে বিষয়টিকে আরেকটু পরিষ্কার করা যাক। ভারতে বিদ্যমান রয়েছে ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন। আর রাষ্ট্রের আইনে ধর্মতত্ত্বকে ধারণ করে সেক্যুলারিজমের কথা চিন্তাও করা যেতে পারে না। সম্প্রতি আমরা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ইসলামি ‘তিন তালাক প্রথা’ নিয়ে বেশ সোচ্চার দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী পুরুষতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী সংস্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলে প্রচারণা চালিয়ে, তা সমগ্র জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি ও তার ফ্যাসিবাদী পার্টি। আর কথিত ধর্মনিরপেক্ষ ও নির্বাচনসর্বস্ব বামপন্থী দলগুলো বিভিন্ন রাজ্য গরুর মাংস খাওয়া ও বিক্রির ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কোনো কথাই বলছে না। হরহামেশা সেক্যুলারিজমের নাম জপলেও তারা দলিত ও মুসলিম নির্যাতন বা গোরক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। আর এর মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদের কাছে নতি স্বীকার এবং তাদের ভেতর ‘নরম হিন্দুত্ববাদ’ ধারণের পরিচয়টাই আরো সুস্পষ্ট হয়।
বছরখানেক আগে উত্তর প্রদেশের দাদরি জেলার বিসারা গ্রামে গরুর মাংস খাওয়ার ‘অভিযোগে’ মোহাম্মদ আখলাক নামে এক মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা করে উগ্রপন্থি হিন্দুত্ববাদীরা। এর কয়েকদিন পর জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দা ১৯ বছরের যুবক জাহিদ আহমেদকে একই অভিযোগে তার ট্রাকে পেট্রোল বোমা মেরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এসব ব্যাপারে অরুন্ধতী রায় বলেন, “গরু খাওয়াকে কেন্দ্র করে যেসব দুর্বৃত্ত এসব হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, তাদের নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত হত্যাকারী তো ওরা নয়। যে রাজনীতি বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী, সেই রাজনীতিই মূলত তাদের হত্যাকারী।”
চার.
অরুন্ধতীর প্রথম কলেজটি ছিল খ্রিস্টান নানদের পরিচালিত। ভবিষ্যত জীবনের কথা মাথায় রেখে তারা তাকে সাচিবিক বিদ্যা নিয়ে পড়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তরুণ অরুন্ধতী এর বদলে দিল্লি চলে গেলেন প্ল্যানিং এন্ড আর্কিটেকচার স্কুলে পড়ার জন্য। তার আর্কিটেকচার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শবাদিতাও কাজ করেছিল। কেরালায় তার পরিচয় হয় ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত ভারতীয় আর্কিটেক্ট লরি বেকারের সঙ্গে। এই স্থাপত্যবিদ টেকসই, স্বল্প ব্যয়ের ভবন নির্মাণের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করেন, স্কুলে তাঁর পক্ষে এ ধরনের কিছু শেখা সম্ভব হবে না। তিনি এক সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে বলেন, “তারা আপনার কাছ থেকে স্রেফ একজন ঠিকাদার ধরনের কাউকে কামনা করেন।” তাঁর প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয় অধ্যাপকদের। তিনি প্রশ্ন তোলেন– “আপনি নান্দনিকতা বলতে কী বোঝেন? কাদের জন্য ডিজাইন করছেন? এমনকি আপনি একটি ঘরের নকশা করার সময় তাতে নারী ও পুরুষের মধ্যে কেমন ভূমিকা থাকা দরকার বলে বিবেচনা করেন?” প্রশ্নগুলো আরো বড় হতে থাকে। অরুন্ধতী বলেন, “নগরী কিভাবে গড়ে ওঠে? কাদের জন্য আইন? কাদের নাগরিক বলে মনে করা হয়? শেষ পর্যন্ত এগুলো আমার কাছে খুবই রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়।”
প্রাতিষ্ঠানিক পড়ার শেষ এসাইনমেন্ট হিসেবে অরুন্ধতী কোনো ভবনের ডিজাইন না করে বরং থিসিস লিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। থিসিসের শিরোনাম ছিল ‘পোস্টকলোনিয়াল আরবান ডেভেলপমেন্ট ইন দিল্লি’। তিনি তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে বিরাজমান বিভিন্ন সাংঘর্ষিক সংস্কৃতি থেকে রস গ্রহণ করেন। কয়েক বছর পর (১৯৮৯) তিনি ‘ইন হুইচ অ্যানি গিবস ইট দোজ ওয়ানস’ চলচ্চিত্রে তিনি তা তুলে ধরেন। তিনি এই সিনেমাটি লিখেছেন, পরিকল্পনা করেছেন, অভিনয়ও করেছেন। অরুন্ধতী ‘রাধা’ নামের কোকড়ানো চুলের এক ‘ভুতুরে চরিত্রে’ আবির্ভূত হন। সিনেমায় দেখা যায়, রাধা লেখক হওয়ার জন্য স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেন, কিন্তু প্রথম উপন্যাসটি শেষ করতে পারেননি।
এরইমধ্যে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলেন অরুন্ধতী। হোস্টেলে থাকার মতো অর্থ না থাকায় তিনি তাঁর বয়ফ্রেন্ড গেরার্ড দা চুনহাকে নিয়ে কাছের এক বস্তিতে উঠেন। বস্তিবাসীদের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তারা নিজেদের বিবাহিত বলে পরিচয় দেন। এ প্রসঙ্গে অরুন্ধতী বলেন, “মহৎ কোনো মিশনের জন্য কোনো তরুণ এমনটা করতে পারে। তবে আমার কাছে বিষয়টা তেমন ছিলো না। তখন আপনজন বলতে কেউ পাশে ছিল না। এতে সুন্দর কিছু ছিলো না। সেটাই ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়। সময়টা ছিলো এমন, যখন সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থান থেকে চিন্তা করা সম্ভব। আর সেটা আমাকে ছেড়ে যায়নি।”
গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর অরুন্ধতী রায় কিছু সময়ের জন্য গেরার্ড দা চুনহার সঙ্গে উপকূলীয় শহর গোয়ায় বসবাস করেন। সেখানে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে করতে থাকেন। ফিরে আসেন দিল্লিতে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আরবান অ্যাফেয়ার্স–এ চাকরি পান। স্বতন্ত্র চলচ্চিত্রকার প্রদীপ কৃষাণের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনিই অরুন্ধতীকে ‘মেসি সাহিব’ (১৯৮৫) নামের ঔপনিবেশিক ভারত সম্পর্কিত একটি চলচ্চিত্রে অন্যতম নারী চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। পরবর্তীকালে তাঁরা বিয়েও করেন।
কৃষাণের ব্যাকগ্রাউন্ডও অরুন্ধতী রায়ের চেয়ে খুব ভিন্ন ছিলো না। ইতিহাসের সাবেক অধ্যাপক কৃষাণ ছিলেন বিপত্মীক। মা–বাবা আর দুই সন্তানকে নিয়ে অভিজাত চানক্যপুরির পাশে একটি বিশাল অগোছালো বাড়িতে বাস করতেন। অরুন্ধতী রায়ের সাথে বিয়ের পর তারা আলাদা একটি অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন। একসঙ্গে তাঁরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কেন্দ্রিক ২৬ পর্বের টেলিভিশন সিরিজ, ‘বরগদ’ নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে হাত দেন। তবে সিরিজটি শেষ করতে পারেননি। তাঁরা ‘অ্যানি’ (১৯৮৯), ‘ইলেকট্রিক মুন’ (১৯৯২) নামে দুটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেন। এর মধ্যে ‘অ্যানি’ চিত্রনাট্য ও ইংরেজিতে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেতা শাহরুখ খান। প্রদীপ কৃষেণ পরিচালিত এই ত্রিভাষিক ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য ছিল অরুন্ধতীর। পাশাপাশি ‘রাধা’ নামের একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
অরুন্ধতী দিল্লির স্বতন্ত্র ধারার চলচ্চিত্রনির্মাণ শিল্পে ব্যাপকভাবে ডুবে যান। এসব মুভির প্রাগ্রসর থিম তাকে আকৃষ্ট করে। ‘ফুলন দেবী’ নামের এক দস্যুরাণীর জীবনকাহিনী নিয়ে তৈরি ‘দ্য বান্ডিট কুইন’ চলচ্চিত্রটি যখন প্রকাশ পায়, ততদিনে তিনি তার উপন্যাস নিয়ে কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন। নীচুজাতের নারী ফুলন দেবী সংঘবদ্ধ ধর্ষণ আর বন্দীজীবন থেকে বেরিয়ে এসে দুর্ধর্ষ গ্যাং লিডারে পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রে ফুলনের জীবনে বিদ্রোহের বিষয়টিকে প্রধান উপজীব্য না বানিয়ে তাকে ধর্ষণের শিকার নারী হিসেবে তুলে ধরার যে প্রয়াস চালানো হয়, তাতে অরুন্ধতী ক্ষুব্ধ হন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি সিনেমাটি দেখে ক্ষেপে গিয়েছিলাম। এর একটি কারণ ছিলো– আমি কেরালায় বেড়ে ওঠেছি, মালায়ালাম চলচ্চিত্রে দেখা যায়, প্রতিটি সিনেমাতে– একেবারে প্রতিটি সিনেমাতেই– কোনো না কোনো নারীকে ধর্ষণ করা হয়। অনেক বছর ধরে আমি বিশ্বাস করে এসেছি, সে সব নারীই ধর্ষিত হন। তখন আমি পত্র–পত্রিকায় পড়লাম, কিভাবে ফুলন দেবী বলেছিলেন যে, এটা তাঁর কাছে আবার ধর্ষিত হওয়ার মতো মনে হয়েছে। যে গ্রন্থটিকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি বানানো হয়েছিল, আমি সেটা পড়লাম, বুঝতে পারলাম যে, এসব লোক তাদের নিজেদের ধর্ষকাম এখানে যুক্ত করেছেন। আমি ভেবে দেখলাম, তারা ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত দস্যুকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত ধর্ষিতায় রূপান্তরিত করেছে।” ওই চলচ্চিত্রকে নিয়ে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান রেপ ট্রিক’ শিরোনামে অরুন্ধতীর প্রবন্ধটি সানডে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। তিনি তাতে ‘দ্য বান্ডিট কুইন’ মুভির নির্মাতাদের নির্দয় সমালোচনা করে বলেন, “তাঁরা এমনকি ফুলন দেবীর সঙ্গে দেখা করা, কিংবা সিনেমাটি দেখতে বলার ফুসরতটুকুও পাননি।”
১৯৯৭ সালে অরুন্ধতীর ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ভারতের ‘স্বাধীনতার’ ৫০তম বার্ষিকীতে। তখন ভারতে আগ্রাসী উগ্র–জাতীয়তাবাদী ও ভোগবাদী অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছিল, আর অরুন্ধতী রায় বিবেচিত হলেন ব্র্যান্ড ইন্ডিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে। তার প্রথম উপন্যাসটি নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পায়, জয় করে বুকার। বইটির ৬০ লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়। সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁর নিতে ব্যস্ত। সব ছবিতেই কেরালার নির্মল জলরাশি আর বিপুল সবুজের সমারোহে তাঁর ঢেউ কোঁকড়ানো চুল ও হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ফুটে উঠছিলো। তাঁর উপন্যাসের প্রেক্ষাপট কেরালা তখন জনপ্রিয় পর্যটন স্পট হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
‘ন্যাশনাল আইকন’ হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার এক বছরের মধ্যেই অরুন্ধতী রায়ের সেই অবস্থান শেষ হয়ে যায়। ওই সময়ে উগ্র–ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালায়। কথিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে এ পারমাণবিক পরীক্ষা জনগণ, বিশেষত মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ব্যাপক ভাবাবেগ সৃষ্টি করে। আর এর মধ্য দিয়ে কার্যত হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ আরো শক্ত সামাজিক ভিত্তির ওপর স্থাপিত হতে থাকে। ‘দ্য ইন্ড অব ইমাজিনেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধে অরুন্ধতী পারমাণবিক পরীক্ষার তীব্র সমালোচনা করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনগণ যখন অর্ধাহারে–অনাহারে কঠিন অবস্থায় বেঁচে আছেন, তখন সেই জনগণের অবস্থার পরিবর্তনের বদলে ক্ষমতাসীন সরকার জনগণের অর্থে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালাচ্ছে। অরুন্ধতী এ কর্মকাণ্ডকে ‘গণবিরোধী’ বলে উল্লেখ করেন। যদিও ‘যুদ্ধবাজ’ অবস্থানের কারণেই বিজেপি আবারো ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলো। এ সময়ে যুগপৎভাবে আউটলুক ও ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনে অরুন্ধতী ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতি ও শাসকশ্রেণীর তীব্র সমালোচনা তুলে ধরেন।
অরুন্ধতীর এ রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর উচ্চবর্ণ, শহুরে, ইংরেজি ভাষাভাষী পাঠকদের ক্ষুব্ধ করে। আর এটা সাধারণদের তাঁর সমর্থকে পরিণত করে। তার নতুন পাঠকদের বেশিরভাগই তাঁর উপন্যাস লেখার কথাটিও শোনেননি। তাঁরা ইংরেজিতে পড়তে অভ্যস্তও নন, ভাষার গণ্ডি পেড়িয়ে অরুন্ধতী পৌঁছে যান ধর্ম, বর্ণ বা গোষ্ঠীগত কারণে যারা নিজেদের প্রান্তিক পর্যায়ে বলে অনুভব করেন, তাঁদের কাছে– যাদের শ্রমে–ঘামে ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান ঘটেছে। অরুন্ধতীর লেখা ভারতে যতগুলো লিখিত ভাষা আছে, প্রায় সবগুলোতেই অনুবাদ হয়। অরুন্ধতী রায় বলেন, “যখন ‘দ্য ইন্ড অব ইমাজিনেশন’ প্রকাশিত হলো, তখন বিপরীত ঘটনা ঘটলো। ইংরেজি পড়ুয়া এলিট লোকজনের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হলো, তবে অন্য এক শ্রেণী সেটা বরণ করে নিলো।”
প্রতিক্রিয়ার প্রচণ্ডতা অরুন্ধতীকে বিস্মিত করল। এতোদিন যারা তাঁর লেখালেখি ও প্রথাবিরোধীতার সমর্থনে গলা উঁচু করছিলেন, এবার তাঁরাও নাখোশ। কারণ অরুন্ধতী কথিত জাতীয় ভাবাবেগকে আঘাত করছিলেন। এ প্রসঙ্গে অরুন্ধতী বলেন, “আমি যদি পারমাণবিক পরীক্ষা নিয়ে কোনো কথা না বলতাম, তবে তার অর্থ হতো– আমি তাতে খুশি হয়েছি। আমি সবসময় ম্যাগাজিনের কভারে ছিলাম। রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে যায় বলে কোনো কথা এড়িয়ে যাওয়ার পক্ষে নই।”
উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি এসময়ে অনেকাংশেই নির্ভর করছে সামরিক শিল্প বা যুদ্ধ অর্থনীতির ওপর। সমগ্র অর্থনীতির ওপর সামরিক খাতের প্রভাব ভীষণভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে; কারণ তা আজ শুধু সমরাস্ত্র বিক্রির মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন ভূখণ্ডে জাতিগত ও ধর্মীয় বিরোধ তৈরি করে ও সেটা টিকিয়ে রেখে সমরাস্ত্রের বাজার বিস্তার করার সঙ্গে আরও জড়িত রয়েছে– গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, প্রতিরক্ষা, স্যাটেলাইট, কর্পোরেট প্রচারমাধ্যম, নির্মাণ শিল্প, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান, তৈরি পোশাক শিল্প, তথ্য–প্রযুক্তি শিল্প, বৃহৎ ব্যাংক, আর্থিক ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং আরো অনেক অনেক শিল্প। অর্থাৎ, অন্যান্য শিল্পের বাজার সমর–শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর এসব মিলিয়েই আজকের কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ অর্থনীতি।
কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের কর্মসূচীতেই তার উদ্দেশ্য প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, ইউএসএইডের মতো আর্থিক সংস্থা, এনজিও, সুশীল সমাজ, কর্পোরেট মিডিয়া প্রভৃতির সম্মিলিত আগ্রাসন নয়া–ঔপনিবেশিক দেশসমূহের শাসকশ্রেণীকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি, ঋণ চুক্তি, সামরিক চুক্তি, পারস্পরিক সহযোগিতামূলক ও অবকাঠামো উন্নয়ন চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের শৃঙ্খলে বেঁধে রেখে অতি–মুনাফার বাজার বিস্তার করে থাকে। একইসঙ্গে চলতে থাকে গোয়েন্দা তৎপরতা, স্থানীয় দালালদের মিত্রতা যাচাই এবং স্বার্থমাফিক ক্ষমতাসীনদের পরিবর্তন। অবস্থা সুবিধের না হলে যাতে সাম্রাজ্যবাদ নির্দেশিত অভ্যুত্থান বা গৃহযুদ্ধ চালানো যায়, সেই অবস্থা সৃষ্টি করাটাও এদের নির্ধারিত কর্মকাণ্ড। আর এ যাত্রায় কিছু অতিব্যবহৃত বুলি থাকে তাদের মুখে– গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, অথবা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ ইত্যাদি। ভিয়েতনাম, সোমালিয়া, কঙ্গো, সুদান, সিরিয়া, ইয়েমেন, মিশর, ইরাক, ফিলিস্তিন, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদ একের পর এক সামরিক আগ্রাসন পরিচালনা করেছে ও করছে। অদূর ভবিষ্যতে তা বাংলাদেশ বা ভারতেও সম্প্রসারিত হতে পারে।
২০১৭ সালে প্রকাশিত সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিউটের (এসআইপিআরআই) ‘ওয়ার্ল্ড মিলিটারি এক্সপেন্ডিচার রিপোর্ট’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালে বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয় হয়েছে ১৬৮৬ বিলিয়ন ডলার, এর আগের বছরের তুলনায় যা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। আর যা বৈশ্বিক জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ। তালিকার প্রথম ১৫টি রাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় ১৩৬০ বিলিয়ন ডলার। সামরিক খাতে ব্যয়ের তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকার পরও তৃতীয় স্থান দখল করেছে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে সামরিক ব্যয় ১ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়িয়েছে। যা ৬১১ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বে ২০১১ সালে মোট সামরিক ব্যয় দাঁড়ায় ১৭৫৬ ট্রিলিয়ন ডলারে। প্রথম সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে কোনো একক বছরে এটাই অস্ত্র বিক্রির রেকর্ড। ২০১২ সালে সমরাস্ত্র কেনাবেচা কমে আসলেও তার পরিধি ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে এবং সমরাস্ত্রের বাণিজ্য এগিয়ে যাচ্ছে নতুন রেকর্ডের দিকে।
সমরাস্ত্র আমদানিতে শীর্ষে থাকা ভারত ২০১৬ সালে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৬ সালে নয়াদিল্লির সামরিক ব্যয় ছিল ৫৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়ে সামরিক ব্যয়ের তালিকায় এখন ভারত রয়েছে পঞ্চম স্থানে। তারা আধুনিক মানের অস্ত্র ও এ সংক্রান্ত প্রযুক্তির জন্য রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইসরায়েল ও দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত, সামরিক ও গোয়েন্দা সম্পর্ক ক্রমেই আরও জোরালো হতে থাকে। ভারত ইতিমধ্যে ইসরায়েলের বৃহত্তম প্রতিরক্ষা সামগ্রী আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। তৎকালীন ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি ২০১৪ সালের ১২ আগস্ট পার্লামেন্টে জানান, সামরিক সম্ভারের ক্ষেত্রে ২০১১ সালের পর ইসরায়েল পরিণত হয়েছে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর) রফতানিকারকে। দেশটি থেকে ভারতের আমদানি ৩৩ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন রুপি। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের ফাঁকে ২০১৫ আলের ২৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার পর নেতানিয়াহু বলেছেন যে, ভারত–ইসরায়েল সম্পর্কটি ‘আকাশের মতো সীমাহীন’।
মোদির নেতৃত্বে প্রতিরক্ষাবিষয়ক ভারতের ক্যাবিনেট কমিটি গত বছর ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য দীর্ঘ দিন ধরে স্থগিত থাকা ৮৮০ কোটি রুপিতে (১৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার) রাফায়েল–ইসরায়েল অ্যারোস্পেশ ইন্ড্রাস্ট্রিজের ডিজাইন করা ২৬২টি বারাক–১ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার বিষয়টি অনুমোদন করে।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে প্রকাশিত সিপরির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ববর্তী ১৫ বছরে ভারতের অস্ত্র আমাদনিতে ব্যয় হয়েছে ১২০ বিলিয়ন ডলার। আগামী দশকে তাদের ব্যয় হবে আরও ১২০ বিলিয়ন ডলার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইসরায়েলের জন্য ভারত বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক। ভারতের সরকারি তথ্যমতে, ২০১২ সালের পর থেকে প্রতিরক্ষা সরবরাহের দিক থেকে রাশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়া থেকে ২৫ হাজার ৪৪৮ কোটি রুপির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হয়েছে ৩২ হাজার ৬১৫ কোটি রুপির অস্ত্র। ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের গোপন প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে বলেও ধারণা করা হয়। সম্প্রতি ভারতীয় কর্মকর্তাদের ঘনঘন ইসরায়েলে যাতায়াত লক্ষ্য করা গেছে। সেই সঙ্গে যৌথ ব্যবস্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণার কথাও সামনে এসেছে। ভারতের সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ইসরায়েল থেকে ভারত নিখুঁত নিয়ন্ত্রিত মিসাইল এবং ১ দশমিক ২ বিলিয়ন রুপির হেরন মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ইউএভি) কিনছে। ভারতের কাছে রাফায়েলের ডিজাইন করা আয়রন ডোম বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বিক্রিরও প্রস্তাব দিয়েছে ইসরায়েল।
ভারত–ইসরায়েল সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায় মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালের ৪ জুলাই মোদি ইসরায়েল সফরে যান। এবারই প্রথমবারের মতো কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েল সফরে গেলেন। মোদিকে যেভাবে স্বাগত জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তাতেও স্পষ্ট যে, ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন এক ভিন্ন মাত্রা পেতে যাচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে সই হওয়া বিভিন্ন খাতের চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকেও তা ফুটে উঠে। বিশেষ করে, দুই দেশের ইতিহাসের বৃহত্তম প্রতিরক্ষা চুক্তি মোদি সরকারের সামরিকীকরণ ও এর জন্য ইসরায়েলের ওপর নির্ভরতারই বার্তা দেয়। পাশাপাশি সফরে মোদির রামাল্লায় না যাওয়াটাও বলে দেয়, ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই অন্তত প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে যে এক ধরনের ‘দূরত্বে’র সম্পর্ক চলে আসছিলো, মোদি জামানায় সেটা অনেকটাই পাল্টে গেছে ‘নৈকট্যে’। ভারতীয় ইহুদি সম্প্রদায়ের গবেষক ও ইতিহাসবিদ এলিয়াজ ড্যানডেকার বলছেন, “মোদি ও নেতানিয়াহু যখন পরস্পরকে আলিঙ্গন করছেন, দৃশ্যটি এমন যেন দীর্ঘদিন পর দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাক্ষাৎ হলো।”
ভারতে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল কারমন বলছেন, মোদির এই সফর দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ’। ইসরায়েলের কাছে এ সফর ‘বিশেষ’ হয়ে ওঠার অন্যতম একটি কারণ হলো সামরিকায়ন ও বাণিজ্য। ভারতের ১৩০ কোটি জনগণ ইসরায়েলের জন্য কাঙ্ক্ষিত এক বাজার। ২০১৬ সালে ভারতে ইসরায়েলের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১০ কোটি মার্কিন ডলার। দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন এই সংখ্যাটা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে, তাতে সন্দেহ নেই। প্রযুক্তি, কৃষি, জ্বালানি, পানি ব্যবস্থাপনা, মহাকাশসহ বিভিন্ন খাতে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে বিভিন্ন চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক। তবে এক্ষেত্রে ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় ভারতের কাছে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করবে ইসরায়েল। মূলত ভারতের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে মোদি আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলারের যে বরাদ্দ দিয়েছেন, তাতেই বড়সড় ভাগ বসাতে যাচ্ছে ইসরায়েল। ফলে মোদিকে স্বাগত জানাতে নেতানিয়াহু বিমানবন্দরে হিন্দিতে সম্ভাষণ জানাবেন, সেটা হয়তো ‘বাড়াবাড়ি’ কিছু নয়।
মার্কিন–ইসরায়েলের ভারত অভিযান প্রসঙ্গে ২০০৮ সালে জেড নেটে প্রকাশিত এক লেখায় অরুন্ধতী রায় বলেছিলেন, “আমরা জানি ইসরায়েল হলো মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার খুঁটি এবং সব থেকে বেশি মার্কিন সাহায্যপুষ্ট রাষ্ট্র। সুতরাং আমেরিকা ও ইসরায়েল ধারণাগতভাবে আলাদা দুটি রাষ্ট্র নয়। এবং খেয়াল করলে দেখবেন, ইসরায়েল ও আমেরিকার মুসলিম বিদ্বেষের সঙ্গে ভারতের অধিকাংশ মানুষের মুসলিম বিদ্বেষ কীভাবে একাকার হয়ে যাচ্ছে।” আজ ওই লেখার ১০ বছর পর ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও দলিতদের ওপর হিন্দুত্ববাদের আগ্রাসন অরুন্ধতীর দূরদর্শিতাকেই নির্দেশ করে।
পাঁচ.
‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসটির সফলতার পর পারমাণবিক বোমার পরীক্ষায় একজন ঔপন্যাসিকের সমালোচনাও শাসকশ্রেণীর নীতি–নির্ধারকরা গিলেছিলেন। কিন্তু এরপর অরুন্ধতী রায় নর্দমা নদীতে বিশাল আকারের বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি কর্পোরেট–বিরোধী অবস্থান খুব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। অরুন্ধতী ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসটির বুকার জয় থেকে প্রাপ্ত ১৫ লাখ রুপি অনুদান হিসেবে এ আন্দোলনে দিয়েছিলেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বাঁধের নির্মাণকাজ এগিয়ে নেয়ার পক্ষে রায় দিলে এই প্রকল্পের ফলে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় থাকা গ্রামবাসীরা প্রতিবাদ করেন। অরুন্ধতী ওই এলাকা চষে বেড়ালেন, প্রতিবাদে যোগ দিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় সমালোচনা করে প্রবন্ধ লিখলেন। ২০০১ সালে পাঁচজন আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের বাইরে এক সভা থেকে তাদের ওপর আক্রমণ করার অভিযোগ এনে অরুন্ধতী রায়, মেধা পাটেকরসহ অন্য অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অরুন্ধতী মামলাটি খারিজ করার আবেদন করেন। আদালত তাতে রাজি হলেন, তবে তাঁর আবেদনের ভাষায় অপমানিত হয়ে অবমাননার অভিযোগে তাকে সাজা দেন। অরুন্ধতী আদালতের বিরুদ্ধে ‘ভিন্ন মত পোষণকারীদের মুখে লাগাম পরানো, হয়রানি করা এবং ভীতি প্রদর্শনের’ অভিযোগ তোলেন। আদালতের রায়ে বলা হয়, “আবেদনকারী একজন নারী, এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আইনের মহানুভবতা প্রদর্শন করে এবং তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে আরো বিজ্ঞতা ও সুবিবেচনার পরিচয় দিতে পারবেন, এমন আশায় অরুন্ধতী রায়কে মাত্র একদিনের কারাদণ্ড এবং দুই হাজার রুপি জরিমানা করা হলো।”
‘ড্যাম/এইজ’ শীর্ষক ২০০২ সালের তথ্যচিত্রে বাঁধ নির্মাণের ফলে আক্রান্তদের পরিসংখ্যান এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের কথা তুলে ধরা হয়। আরো তুলে ধরা হয় অরুন্ধতী রায়ের কারাবরণের চিত্র। একদিন কারাগারে কাটিয়ে তিনি যখন বের হলেন, তখন তার ‘ন্যাশনাল আইকন’ থেকে রূঢ় ‘জাতীয় সমালোচক’ হিসেবে রূাপান্তরিত হওয়াটা সম্পন্ন হয়ে গেছে। তিনি সংগ্রামী মানুষের মনে স্থান করে নেন। অপরদিকে ড্যামের বিরোধিতা করার জন্য ভারতীয় প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমগুলো তার তীব্র সমালোচনা করে। এসব মিডিয়ার কাছে বাঁধই ভারতের অগ্রযাত্রার প্রতীকে পরিণত হয়েছিলো।
অরুন্ধতী বলেন, “নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এতে সর্বস্তরের ভারতীয়দের সম্মিলন ঘটেছিলো। এটি ছিলো আদিবাসী, উচ্চ বর্ণের বড় কৃষক, দলিত এবং মধ্যশ্রেণীর মধ্যকার জোট। শহরের সঙ্গে গ্রামের, কৃষকের সঙ্গে জেলের, লেখক এবং শিল্পীদের সংযোগ ঘটিয়েছিল এই আন্দোলন। এই বিষয়টিই আন্দোলনকে দিয়েছিলো বিস্ময়কর শক্তি। আবার একই কারণেই এই আন্দোলনকে অনেকে সমালোচনা করেছিল এই বলে যে, এটা তো মধ্যশ্রেণীর আন্দোলন। এসব শুনলে রাগ লাগে। মধ্যশ্রেণীর শহুরে ইঞ্জিনিয়াররা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আপনি এটা আশা করতে পারেন না যে, শুধু আদিবাসীরাই সমালোচনা করবে। আপনারাই তাদেরকে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন, যাতে তাদেরকে সহজেই কাবু করা যায়। বিভিন্নভাবে এই আন্দোলনে মধ্যশ্রেণীর অংশগ্রহণকে অন্যায্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তোমরা কি করে এই মানুষগুলোর পক্ষে কথা বলো?’ কেউই কারো পক্ষে কথা বলছে না। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন একটি অসাধারণ উদাহরণ– যেখানে বর্ণ ও শ্রেণী চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ একে–অপরের দিকে হাত বাড়িয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর এটি সবচেয়ে বড়, সুন্দর, চমৎকার আন্দোলন।”
অরুন্ধতীর মতে, নর্মদার ইতিহাস হলো– তার পাড়ে বসবাসকারী লাখো মানুষের হাজারো বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। যা হিন্দুত্ববাদের ইতিহাস থেকে বহু পুরনো। আর এই ইতিহাস জনগণের সামনে তুলে ধরাটা লেখক, শিল্পীদের কর্তব্য। অরুন্ধতীসহ এ আন্দোলনে যুক্ত অন্যান্যরা সেই কাজটাই করেছিলেন।
বাঁধ নির্মাণের পেছনে যে কথিত উন্নয়নের বুলি আওড়ানো হয়, তিনি সেই উন্নয়নের মিথ তুলে ধরে বলেন, “প্রথমত আপনাকে বুঝতে হবে যে, বাঁধ সম্পর্কিত মিথ আমাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল আমাদেরই পাঠ্য বইয়ে যখন আমাদের বয়স তিন বছর। নেহেরু বলেছিলেন, ‘বাঁধ হলো আধুনিক ভারতের মন্দির।’ ফলে সেগুলো যেন হয়ে ওঠে বিশাল ভেজা ভেজা জাতীয় পতাকা। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের আগে মনে হচ্ছিল যেন, বাঁধ আমাদেরকে বিছানায় সকালের নাস্তা এনে দিবে, এটা আপনার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করবে এবং জন্ডিস হলেও তা সারিয়ে দিবে। জনগণকে বুঝতে হবে যে, রাজনৈতিক দুর্নীতির কাছে তারা মূর্তির মতো, এবং খুবই অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হতেই তাদের উৎপত্তি। আপনি প্রাকৃতিক সম্পদকে মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রে মজুত করছেন এবং সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন কাকে এ সম্পদ ব্যবহার করতে দিবেন। অতীতে যেখানে আমরা দেখেছি, এসব সম্পদ বড় বড় কর্পোরেটদের হাতেই তুলে দেওয়া হয়েছে।
“…নর্মদার ওপর নির্মিত প্রথম বাঁধ ‘বার্গি’, যার নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৯০ সালে। জানা যায় এটি ৭০ হাজার মানুষকে গৃহহীন করেছিল, ডুবিয়ে দিয়েছিল ১০১টি গ্রাম। একদিন হঠাৎ কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সরকার জলাধার পূর্ণ করে দেয় যার ফলে ১ লাখ ১৪ হাজার মানুষ উচ্ছেদ হন এবং ১৬২টি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানি উপচে উঠলে লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তারা তাদের সন্তান ও গবাদী পশু নিয়ে পাহাড়ে উঠে পড়ে। ১০ বছর পর দেখা গেল বাঁধ নির্মাণের ফলে যে পরিমাণ জমিতে পানি সর্বরাহ করার কথা, তার মাত্র ৫ শতাংশেই কেবল সেচের মাধ্যমে পানি সরবরাহ সম্ভব হয়। যে পরিমাণ জমি এই বাঁধের ফলে তলিয়ে যায়, তার চেয়েও কম জমিতে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়। তারা কোনো খাল খনন করেনি। কারণ কন্ট্রাক্টর এবং রাজনীতিবিদদের জন্য শুধু বাঁধ নির্মাণ করাটাই আনেক টাকার ব্যাপার।”
বাঁধ নির্মাণের ফলে বাস্তুচ্যূত মানুষের সংখ্যা প্রসঙ্গে অরুন্ধতী বলেন, “আমি যখন ‘দ্য গ্রেটার কমন গুড’ লিখতে শুরু করলাম, তখন হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এবং টিকে থাকা মানুষের সংখ্যা জেনে আমি আতঙ্কিত হই। বড় বাঁধগুলির কারণে ঠিক কতো লোক বাস্তুচ্যূত হয়েছিল, তার কোনো সঠিক হিসেব ভারত সরকারের কাছে নেই। আমার মতে, এটা শুধু শুধু রাষ্ট্রের ব্যর্থতা নয়, এটা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়েরও ব্যর্থতা। অনুপস্থিত লোকের এই সংখ্যার পিছনে কারণ হলো– তারা ছিলেন অ–জনগণ, আদিবাসী এবং দলিত। আমি ভারতীয় জনপ্রশাসন সংস্থা কর্তৃক নির্মিত ৫৪টি বাঁধের বৈধতা যাচাই করি। এই নিরীক্ষায় জানতে পারলাম, বাঁধ নির্মাণের কারণে উচ্ছেদের ফলে গড়ে প্রতি বাঁধে ৪৪ হাজার মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন, যা কিনা বিশাল উচ্ছেদের মধ্যে একটি। ধরা যাক, এই ৫৪টি বাঁধ বড় সড় বাঁধগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। যে গড় আমরা পেলাম, তার চার ভাগের এক ভাগ আমরা গ্রহণ করি। গত ৫০ বছরে ভারতে এমন ৩,৬০০টি বড় বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বাঁধ নির্মাণের ফলে ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তারা সবাই শহরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানেও তারা নাগরিকের মর্যাদা পাননি, বাস করছেন বস্তিতে। যেকোনো মুহূর্তে তাদেরকে বিতাড়িত করা হতে পারে, যদি নয়াদিল্লির উচ্চশ্রেণীর গৃহিনীরা মনে করেন যে, ওই বস্তিবাসীরা বিপজ্জনক।”
ছয়.
১৯৯২ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়েই সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে ভারতে সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী দাপট সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছাতে থাকে। হিন্দুত্ববাদী তাণ্ডবকালে কেন্দ্রে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিলো। হিন্দুত্ব ভোট হারানোর ভয়ে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তখন বোম্বে শহরে চালানো তাণ্ডবে নেতৃত্ব দেয় শিবসেনা নামের সন্ত্রাসী সংগঠন।
অযোধ্যা হামলার দশ বছর পর ২০০২ সালে গুজরাটে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের উত্থান ও সাম্প্রদায়িক নিধনযজ্ঞ চালানো হয়। বরাবরই হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সমান সরব ছিলেন অরুন্ধতী। তিনি দুই সহস্রাধিক মানুষ কচুকাটার পর এ নিয়ে ‘মায়া কান্না’ কাঁদেননি। তিনি দেখান, এ হত্যাযজ্ঞ মূলত হিন্দুত্ববাদী বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণারই অংশ।
২০০৩ সালের মে মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেন, “২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে উত্তর প্রদেশের নির্বাচন নিয়ে বিজেপি মেতেছিলো এবং বরাবরের মতোই তারা তাদের তুরুপের তাস অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণকে নির্বাচনী ইস্যু করেছিলো। ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তাতিয়ে উঠে। বিজেপির লোকজন ট্রেনে করে অযোধ্যা যাচ্ছিলো মন্দির নির্মাণ কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার জন্য। সে সময় একমাত্র গুজরাটই ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য যার কারণে ক্ষমতায় বিজেপি। এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে চলছিলো হিন্দু ফ্যাসিবাদের চূড়ান্ত প্রয়োগের প্রস্ততি।
“ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের কর্মীভর্তি একটি ট্রেন কে বা কারা থামিয়ে দেয় গোধরা স্টেশনের কাছে, রাতের অন্ধকারে। এই কর্মীরা অযোধ্যা যাচ্ছিলো রামমন্দির নির্মাণ কর্মসূচিতে যোগ দিতে। একটা গোটা বগি জ্বালিয়ে দেয়া হয়, জীবন্ত দগ্ধ হয় ৫৮ জন মানুষ। প্রকৃত সত্যটা কেউই জানে না, এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য কে দায়ী?
“কিন্তু গোধরার ঘটনার ঘন্টাখানেকের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণহত্যা। অন্তত ২০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়, উদ্বাস্তু হন অন্তত ৫০ হাজার। নারীদের প্রকাশ্য রাস্তায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। শিশুদের সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হয় মা–বাবাকে। অন্তঃসত্ত্বা নারীর পেট চিরে ফেলা হয়।
“কম্পিউটারে প্রিন্ট আউট নেয়া তালিকা ধরে ধরে মুসলমানদের দোকান–পাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট করা হয়, জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ঘরবাড়ি, মসজিদ মাটিতে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়। ট্রাকভর্তি হাজার হাজার গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে তারা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে। এই প্রস্ততি কিন্ত আগে থেকেই নেয়া! পুলিশ উন্মত্ত হিন্দু দাঙ্গাকারীদের প্রতিরোধে কিছু তো করেইনি বরং তাদের নিশ্চিন্তে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে দিয়েছে।
“এর কয়েকমাস পর গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট করেই বলেছেন, তারা আগাম নির্বাচন চেয়েছিল এবং ধারণা করেছিল এই মুসলিম গণহত্যা তাদেরকে হিন্দু ভোটারদের মন জয় করতে সাহায্য করবে।”
গুজরাট গণহত্যা নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক রানা আইয়ুবের প্রথম বই ‘গুজরাট ফাইলস: অ্যানাটমি অব অ্যা কাভার আপ’ (Gujarat Files: Anatomy of a cover up) প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালের ২৫ মে। নিজের মুসলিম পরিচয় গোপন করে ‘মৈথিলী ত্যাগী’ নাম নিয়ে একইসঙ্গে দুটি ভিন্ন জীবন–যাপন করে অনুসন্ধান চালান তিনি। দীর্ঘ পাঁচ বছরের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য ও বক্তব্যের ওই সংকলনে রানা ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত গুজরাটে দায়িত্ব পালন করা রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিবিড় আলাপচারিতা তুলে ধরেছেন। এতে ওই কর্তাব্যক্তিরা পদ্ধতিগত গণহত্যার বিবরণ দিয়েছেন। বিশেষ করে তখনকার মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদির কিছু সিদ্ধান্ত যে গণহত্যার জন্য দায়ী তা উঠে এসেছে গুজরাট ফাইলসে। এসব তথ্য রানাকে জানিয়েছেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাই। গণহত্যার জন্য যে মোদি দায়ী, এমন সাক্ষ্য–প্রমাণ দাঁড় করিয়েছেন রানা। তাঁর কাছে গোপনে রেকডকৃত মোদির অন্তরঙ্গ আলাপচারিতাও রয়েছে বলে রানা জানিয়েছেন।
সরকার, প্রশাসন এমনকি বিচারবিভাগের উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের অনেকের মধ্যে কী পরিমাণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতা বিরাজ করে, তারও কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে বইটিতে। এমন একটি উদাহরণ হলো এক জ্যেষ্ঠ বিচারকের মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য। তিনি গণহত্যার বিষয়ে বলেছেন, “ওই মুসলমানরা কখনো বদলাবে না। তাদের প্রতি এমনটা হওয়ার বিকল্প ছিল না।” আবার অনেক কর্মকর্তা গণহত্যার ঘটনায় তাদের করার কিছুই ছিল না বলে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন রানার কাছে।
গুজরাট গণহত্যার নৃশংসতার বিবরণ জানিয়ে, ডেমোক্র্যাসি নাও–কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায় বলেন, “এহসান জাফরী একজন মুসলিম ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন মজদুর আন্দোলনের একজন নেতা আর গুজরাটের আইনসভার সাবেক সদস্য। একটা ট্রেনে হিন্দু কর–সেবকদের পুড়ে যাওয়ার ঘটনার পর, যখন হুজুগে জনতা এর জবাবে মুসলিম সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, আর মুসলিমদের রাস্তায় ফেলে হত্যা, নারীদের ধর্ষণ ইত্যাদি শুরু করল, তখন মোটামুটি ৬০ জনের মতো আশ্রয় নিয়েছিল আহমেদাবাদের একটা আবাসন কলোনিতে এহসান জাফরীর সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরে, এই আশা নিয়ে যে তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা, তাই তিনি হয়তো তাদের বাঁচাতে সক্ষম হতে পারেন। একটা ভিড় জমা হলো। এহসান জাফরী ২০০ বার ফোন করেছিলেন সব রাজনৈতিক নেতাকে। পুলিশ এসে চলে যায়। কেউ কিছু করেনি। ভিড়ের সঙ্গে কথা বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি, তাঁদের অনুরোধ করতে নারী ও শিশুদের রেয়াত করার জন্য। তারা হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করল। তাঁকে হত্যার পর অন্য সবাইকেও হত্যা করল। তারপর খুনিরা ক্যামেরার সামনে এই বিষয়ে বড়াই করে বলল।
“…সেই সময় মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাই সেই সময়কার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায় তাঁর ওপর বর্তায়। আর অবশ্যই, তখন নির্বাচন খুব কাছে ছিল। জানেন, ভারতের বেশির ভাগ গণহত্যাই নির্বাচনের খুব কাছাকাছি সময়ে হয়। তারা নির্বাচনকে সমবর্তিত করে, আর তাই তিনি নির্বাচনগুলো জিতে যান। আর যখন তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, রয়টার্স তাঁকে প্রশ্ন করেছিল, তিনি দায়িত্বে থাকার সময় ২০০২ সালে গুজরাটে যা ঘটেছিল, তার জন্য তিনি অনুতপ্ত কি না, তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ‘যখন আমি একটা গাড়ি চালাচ্ছি, তখন যদি কোনো কুকুরছানা তার চাকার তলায় চলে আসে, আমি সেটা নিয়ে অনুতাপ করব?’
“…আমি ওগুলোকে দাঙ্গা বলব না, সেটা ছিল গণহত্যা।”
ওই সময়ে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম ব্যক্তিকে পুলিশের ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যার বর্ণনাও রয়েছে রানা আইয়ুবের ওই বইয়ে। জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তারা এসব নিয়ে এমনভাবে কথা বলেছেন, যেন এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। তারা এ হত্যাকাণ্ডকে নিজের কাজের অংশ হিসেবেই নিয়েছিলেন।
ওই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ভুয়া এনকাউন্টারগুলোর মধ্যে একটি ছিলো ইশরাত জাহান হত্যাকাণ্ড। ১৫ জুন ২০০৪ ভোরে আহমেদাবাদের রাস্তায় কথিত ‘এনকাউন্টারে’ নিহত হন চারজন। জীশান জোহর, আমজাদ আলী রানা, জাভেদ গোলাম শেখ এবং ইশরাত জাহান। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে বলা হয়, তারা ‘সন্ত্রাসবাদী’। তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রে তারা জড়িত ছিলেন বলে দাবি করা হয়। গুজরাট পুলিশ (ক্রাইম ব্রাঞ্চ) এবং ইনটেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)-এর এনকাউন্টারে তারা নিহত হন।
ওই ঘটনার পর ইশরাতের মা শামীমা কাউসার গুজরাট হাইকোর্টে ‘এনকাউন্টার’এর তদন্তের আবেদন করেন। এরও অনেক পরে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) ওই এনকাউন্টারের তদন্তভার হাতে নেয়। তদন্তে উঠে আসতে থাকে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। যা পুরো শাসন কাঠামোর জবাবদিহিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
সিবিআই ওই ভুয়া এনকাউন্টার–এর জন্য অভিযুক্ত গুজরাট পুলিশের ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে। এজন্য তারা ১৭৯ জন সাক্ষীর তালিকাও তৈরি করেন। ওই ৮ পুলিশ সদস্য হলেন– পিপি পান্ডে (অতিরিক্ত ডিজিপি), ডিজি বানজারা (ডিআইজি), জিএল সিংঘল (এসপি), এনকে আমিন (ডেপুটি এসপি), টিএ বারোত (ডেপুটি এসপি), অনুজ চৌধুরী (কমান্ডো) এবং জেজি পারমার (অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি এসপি)। এই ৮ জনের মধ্যে পান্ডে এবং বানজারা বাদে বাকি সবাই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। তবে গুজরাট পুলিশের ফাইল করা মূল এফআইআর–এ ওই আট জনের নামই ছিল, যারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং ওই ভুয়া এনকাউন্টারে গুলি চালান। রানা আইয়ুবের অনুসন্ধানী বইয়ে ইশরাত জাহান এনকাউন্টার মামলায় অভিযুক্ত জিএল সিংঘালের সঙ্গে তাঁর কথোপকথনও রয়েছে। যেখানে ওই পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার কথা স্বীকার করেন।
ইশরাত জাহান এনকাউন্টার মামলায় গুজরাট পুলিশের করা এফআইআর–এর বয়ান অনুযায়ী, “জঙ্গিরা যে ইন্ডিকা গাড়িতে ছিলেন, তাতে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, যা তারা মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর আত্মঘাতী হামলা করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলেন।”
পরে গুজরাট হাইকোর্টে পেশ করা স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম (এসআইটি)-এর এফআইআর–এ বলা হয়, “গাড়ি থেকে একটা ১৭ কেজি ওজনের হলুদ পাউডার সমেত বন্দুকের ব্যাগ পাওয়া গেছে। গান্ধীনগরের ডিরেক্টরেট ফরেনসিক সায়েন্স এবং ভদোদরার ডেপুটি চিফ কন্ট্রোলার অব এক্সপ্লোসিভস এগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে জানায় যে, হলুদ রঙের সেই কেমিক্যাল মিশ্রণটি কোনোভাবেই বিস্ফোরক ছিল না।”
গুজরাট পুলিশ ওই গাড়ির ছাদ থেকে পাওয়া ৩০টি নারকেলকেও বোমা বলে উল্লেখ করেছিল। পরে ধর্মান্তরিত হওয়া জাভেদ শেখ ওরফে প্রাণেশ পিল্লাই–এর বাবা গোপিনাথ পিল্লাই–এর জবানবন্দীতে জানা যায়, ওই নারকেলগুলো জাভেদের বাবা তাঁর ছেলে কেরালার বাড়ি থেকে ফেরার সময় নাতির জন্য পাঠিয়েছিলেন।
গোপিনাথ পিল্লাই ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আউটলুক ইন্ডিয়াকে আরও জানান, গুজরাট পুলিশ তাকে জানিয়েছিলেন, এনকাউন্টারের আগে জাভেদ ১৪ দিন নিখোঁজ ছিলেন। আর সে সময়ে তিনি পাকিস্তান গিয়েছিলেন। অথচ ওই সময়ে জাভেদ কেরালায় তার বাবার সঙ্গে ছিলেন বলে গোপিনাথ উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বানজারার ফোন পেয়ে জাভেদ কেরালা থেকে তার নীল রঙের ইন্ডিগো গাড়িতে চড়ে মুম্বাই ফিরেছিলেন।
গুজরাট পুলিশের এফআইআর–এ জীশান জোহর এবং আমজাদ আলী রানাকে ভুয়া পরিচয়ে পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সিবিআই তদন্তে এই বিষয়টি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়।
২০০৯ সালে আহমেদাবাদের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এসপি তামাং ওই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করেন। তাঁর ২৪৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই হত্যাকাণ্ডে গুজরাটের কুখ্যাত ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ ডিজি বানজারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। ১২ জুন ইশরাত জাহানসহ তিন মুসলিম যুবককে মুম্বাই থেকে অপহরণ করে পুলিশ। সেখান থেকে তাদের নিয়ে আসা হয় আহমেদাবাদে। দুদিন ধরে তাদের নির্যাতন করা হয়। পুলিশ যদিও প্রচার করেছে, তারা ১৫ জুন মারা গেছেন। কিন্তু তামাং তার প্রতিবেদনে নিশ্চিত করে বলেছেন, পুলিশ হেফাজতেই তাদের হত্যা করা হয় ১৪ জুন সন্ধ্যা থেকে রাতের কোনও এক সময়ে। হত্যার পর শহরের উপকণ্ঠে মরদেহগুলো ফেলে আসা হয় ভোরের আলো ফোটার আগেই। একে–৫৬সহ কিছু অস্ত্র ও বিস্ফোরক সাজিয়ে রাখা হয় মদেহগুলোর আশেপাশে, যাতে সবাইকে বিশ্বাস করানো যায় যে, তারা আসলেই সন্ত্রাসী ছিল।
উল্লেখ্য, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও তাদের ‘সন্ত্রাসী’ প্রমাণ করতে হলফনামা দেওয়া হয়, যেখানে তৎকালীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের স্বাক্ষর রয়েছে। সম্প্রতি তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব গোপাল কৃষ্ণ পিল্লাই জানান, মন্ত্রণালয়ে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ওই চার ‘সন্ত্রাসী’র সঙ্গে কাশ্মীরের সশস্ত্র সংগঠন লস্কর–ই–তৈয়বার যোগাযোগ ছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট তামাং তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ব্যক্তিগত কারণ ছাড়াও পদোন্নতি এবং তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুগ্রহ পাওয়ার উদ্দেশ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। আর তারা তা পেয়েছিলেনও। ওই ভুয়া এনকাউন্টারের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গুজরাট সরকার তাদের প্রত্যেককেই পদোন্নতি দিয়েছিল।
এসআইটি–র তদন্ত কর্মকর্তা সতীশ বর্মা বলন, “আমরা ইশরাত জাহান যে কলেজে এবং কোচিং সেন্টারে পড়তেন, সেখানে অনুসন্ধান করেছি। তদন্তের পর আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, তার কোনও সন্ত্রাসী যোগাযোগ ছিল না।” তিনি আরও বলেন, “জাভেদেরও কোনো সন্ত্রাসী সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
তবে যে মামলা চলছে এনকাউন্টার নিয়ে, সেখানে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আইবি অফিসারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে সিবিআই। ওই চার্জশিটে নাম রয়েছে ইন্টালিজেন্স ব্যুরো অফিসার রাজেন্দ্র কুমার, স্পেশাল ডিরেক্টর রাজিন্দর কুমার ছাড়াও অন্য তিন অফিসার পি মিত্তল, এম.কে সিনহা ও রাজীব ওয়াংখেড়ের। অভিযোগপত্র থেকে বিজেপি প্রধান অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদির নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ওই হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজনদের তালিকায় অমিত শাহ, মোদির নামও যুক্ত ছিল। সম্ভবত আরো গভীর তদন্তে এমন আরো কয়েকটি হাই–প্রোফাইল নাম বেরিয়ে আসতে পারতো।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ইন্টালিজেন্স ব্যুরোর তত্কালীন জয়েন্ট ডিরেক্টর রাজিন্দর কুমার একে ৫৬ রাইফেলটি গুজরাট পুলিশের জিএল সিংঘলের হাতে তুলে দেন। সিংঘল নিজামুদ্দিন সাইদের হাত ঘুরে তা তরুণ বারোতের কাছে পৌঁছায়। সেই অস্ত্রই ভুয়া এনকাউন্টারে সময় ব্যবহার করা হয়।
সিবিআই ডিরেক্টর রনজিত সিনহা জানিয়েছেন, জাতীয় স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে আইবি অফিসারদের ওপর কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। তিনি বলেন, “আমাদের হাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে যে, আইবি কর্মকর্তারাই ইশরাত আর জাভেদকে আইবি–র আস্তানায় তুলে নিয়ে যান। আমরা কোনোভাবেই ওই কর্মকর্তাদের নাম বাদ দিতে পারি না।”
সিবিআই চার্জশিটের পর কংগ্রেসের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে ভুয়া এনকাউন্টারের ঘটনায় সরাসরি জড়িত রয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। আবার তৎকালীন কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম এনকাউন্টারের হলফনামায় স্বাক্ষর করে ভুয়া এনকাউন্টারকে বৈধতা দিয়েছিলেন। এই ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ভারতের পুরো শাসন কাঠামোকেই এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। সেই সঙ্গে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইস্যুটি যে রাজনীতির অন্যতম হাতিয়ার, সেই বিষয়টিও সামনে আসে। উপরোল্লিখিত প্রতিবেদন প্রকাশের সময়ে ম্যাজিস্ট্রেট তামাং বলেছিলেন, “রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, প্রাপ্ত তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে এই তদন্ত প্রতিবেদন গঠন করা হয়েছে…” অর্থাৎ ভারতের কথিত স্বাধীন বিচার বিভাগেও যে রাজনৈতিক বিবেচনা বিশেষভাবে কার্যকর রয়েছে, এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রচ্ছন্নে তিনি এটির স্বীকারোক্তিও প্রদান করেন।
উল্লেখ্য, কুখ্যাত ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ ডিজি বানজারা আরেক মুসলিম ধর্মাবলম্বী সোহরাব উদ্দিন ও তার স্ত্রীকে ভুয়া এনকাউন্টারে হত্যার দায়ে আগে থেকেই অভিযুক্ত। সোহরাব উদ্দিন এনকাউন্টার মামলায় বিজেপির বর্তমান প্রধান অমিত শাহ সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। ওই মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষাণ লোয়ার আদালতে বিচারাধীন ছিলো। মামলা থেকে অমিত শাহের নাম বাদ দেওয়ার জন্য ১০০ কোটি রুপি ঘুষ দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই নাগপুরে এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বিচারপতি লোয়া, ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরে ওই মামলাটি যায় বিচারপতি এমবি গোসাভির আদালতে। আর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে অমিত শাহের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ খারিজ হয়। অকাট্য তথ্য–প্রমাণ না পাওয়া গেলেও ধারণা করা হয় লোয়াকে হয়তো পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুর তদন্ত করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।
গত ১২ জানুয়ারি ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর কর্তৃত্বকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করেছেন দেশটির সুপ্রিম কোর্টের চার জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। দিল্লিতে বিচারপতি জাস্তি চেলামেশ্বরের বাসভবনের লনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তারা বলেছেন, প্রধান বিচারপতি এখন তার ব্যক্তিগত মর্জি–মাফিক বিভিন্ন বেঞ্চে মামলা পাঠাচ্ছেন। এটি আদালতের নিয়ম–কানুনের লঙ্ঘন। বিচারপতি চেলামেশ্বর ছাড়া অপর তিনজন হলেন–বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি মদন লকুর ও বিচারপতি কুরিয়ান জোসেফ। ভারতীয় বিচার বিভাগের ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
সুপ্রিম কোর্টের এই চার ক্ষুব্ধ বিচারপতি সংবাদ সম্মেলনে একটি চিঠি প্রকাশ করেছেন। যা তাঁরা এর আগে প্রধান বিচারপতিকে পাঠিয়েছিলেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, বেশ কয়েকটি বিচারিক নির্দেশের ব্যাপারে তারা অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন। যেসব মামলার রায় ভারতের রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সুদুরপ্রসারি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হয়, প্রধান বিচারপতি সেই মামলাগুলো বেছে বেছে তার পছন্দসই কিছু বেঞ্চে পাঠান। এমনটা করলে দেশে বিচার বিভাগের সার্বিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে। সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, আলোচিত সোহরাব উদ্দিন এনকাউন্টার মামলা থেকে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রধানকে বাঁচাতে পরিকল্পিতভাবে মামলাটি যখন কনিষ্ঠ বিজেপি ঘেঁসা বিচারপতি এমবি গোসাভির আদালতে পাঠানো হয়, তখন থেকেই জ্যেষ্ঠ বিচারপতিরা এ প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
সাত.
২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর অরুন্ধতী রায় শ্রীনগরে ‘কাশ্মীরের ভবিষ্যত কী?’ শীর্ষক সেমিনারে যোগ দেন। সেখানে তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর জোট হুরিয়ত কনফারেন্সের নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানি, জম্মু–কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের (জেকেএলএফ) চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইয়াসিন মালিকসহ আপামর কাশ্মীরি জনগণের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে নিজের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত ভারত রাষ্ট্রের বিষফোড়ায় পরিণত হন। অরুন্ধতী বলেন, “কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়। কাশ্মীর সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা।” তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে গ্রেফতারের জন্যও তোড়জোর চলতে থাকে।
অরুন্ধতী রায় তাঁর বিরুদ্ধে আনা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ খণ্ডন করে শ্রীনগরে এক বিবৃতিতে বলেন, “আমি যা বলেছি, তা কাশ্মীরীরা রোজ হাজারবার বলছে। আমার ভাষণের অন্তর্নিহিত সুর কাশ্মীরীদের প্রতি ন্যায়বিচার। নির্বিচারে খুন,ধর্ষণ হয়েছে, অপরাধীদের শাস্তি হয়নি। তাই উঠেছে স্বাধীনতার আওয়াজ।
“আমার বিরুদ্ধে মামলার করার জন্য আদালত দিল্লি পুলিশকে আদেশ দিয়েছে। এর বিরুদ্ধে আমার প্রতিক্রিয়া হলো– সম্ভবত তাদের জওহরলাল নেহরুর বিরুদ্ধেও মরণোত্তর মামলা করা উচিত। কারণ কাশ্মীর বিষয়ে বা কাশ্মীরের পক্ষে বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন সময়ে তিনি কথা বলেছেন।
“ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি টেলিগ্রামে বলেন, ‘আমার একটা বিষয় পরিষ্কার করা উচিত যে, জরুরি অবস্থার ভেতর কাশ্মীরকে সহায়তা করার প্রশ্নটা রাজ্যটিতে ভারতের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য নয়। আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বারবার খোলাখুলিই বলেছি, যে কোনো বিতর্কিত ভূখণ্ডে বা রাজ্যে প্রবেশের সিদ্ধান্ত সেই অঞ্চলের জনগণের সম্মতি মেনেই নেওয়া হবে। আমরা এই সিদ্ধান্তই সমর্থন করি।’ (২৭ অক্টোবর, ১৯৪৭)
“আরেকটা টেলিগ্রামে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে নেহরু বলছেন, ‘মহারাজার সরকার ও রাজ্যের বিভিন্ন জনপ্রিয় মুসলিম সংগঠনের অনুরোধে ভারতে কাশ্মীর অন্তর্ভুক্তি আমরা মেনে নিয়েছি। এই শর্তে এটা মেনে নেওয়া হয়েছে যে, খুব শিগগির সেখানে আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনবে। কাশ্মীরের জনগণই কেবল অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। কোন দেশের নিয়ন্ত্রণে তারা যাবেন, তা তাদের জন্যই খোলা থাকলো।’ (৩১ অক্টোবর, ১৯৪৭)”
তবে নেহেরু যা–ই বলুন না কেন, কাশ্মীরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কখনোই কাশ্মীরিদের হাতে আসেনি। বরং কাশ্মীর দিনকে দিন লাখো সেনা দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা, ইতিহাসবিদ আর রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, কাশ্মীর ক্রমেই ভারত–পাকিস্তানের সমরাস্ত্র প্রদর্শনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আর তাতে প্রাণ হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। মানবাধিকারকর্মীদের দাবি অনুযায়ী, ’৪৭–এর পর থেকে অন্তত পাঁচ লাখেরও বেশি কাশ্মীরি নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও দশ লাখের মতো। খোদ ভারতের সরকারি হিসাবে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রভাবশালী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এক রিপোর্টে জানাচ্ছে, ১৯৯০ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে কেবল ১১ বছরেই ৪৩,৪৬০ জন কাশ্মীরি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক কাশ্মীরি। আর মানবাধিকার কর্মীদের দাবি অনুযায়ী ওই ১১ বছরে নিহতের সংখ্যা ১ লক্ষাধিক এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আরও ১ লাখ। এ সময়ে কাশ্মীরে প্রায় ৭ লাখ সেনার উপস্থিতিই জানান দিচ্ছে ভারতীয় দখদারিত্বের।
২০০১ সালে দিল্লিতে ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে হামলায় সংশ্লিষ্টতার দায়ে ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিহার জেলে ফাঁসি কার্যকর করা হয় আফজাল গুরুর। অথচ ওই হামলার সঙ্গে কোনো সুস্পষ্ট যোগসূত্র রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি, যার ভিত্তিতে আফজাল গুরুকে নিশ্চিতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায়। বরং এটি ছিল ভারতের কথিত স্বাধীন বিচার বিভাগের দ্বারা এক বিচারিক হত্যাকাণ্ড। অরুন্ধতী রায়সহ ভারতের গণতান্ত্রিক অধিকারকর্মীরা প্রথম থেকেই এমনটাই দাবি করে আসছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ৫ জন সশস্ত্র ব্যক্তি গাড়িবোমা হামলা চালান। তাদের চ্যালেঞ্জ করা হলে গাড়ি থেকে বের হয়ে তারা গুলিবর্ষণ করে আট নিরাপত্তাকর্মী ও এক মালীকে হত্যা করেন। পরে বন্দুকযুদ্ধে হামলাকারীদের ৫ জনই নিহত হন।
ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল দাবি করে, তারা ঘটনার আসল পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে পেয়েছেন। এ ঘটনার মূল পলিকল্পনাকারী হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে দিল্লি ইউনিভার্সিটির আরবীর শিক্ষক এসএআর গিলানি এবং কাশ্মিরের শ্রীনগর থেকে শওকত গুরু ও তার চাচাতো ভাই আফজাল গুরুকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গ্রেফতার করা হয় শওকতের স্ত্রী আফসান গুরুকে। গিলানি, শওকত ও আফজালকে একটি দ্রুত বিচার আদালতে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পরে হাইকোর্টে খালাস পান গিলানি ও আফসান গুরু। আর ২০০৫ সালের ৫ আগস্ট সুপ্রিমকোর্টের রায়ে আফজাল গুরুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আইবিএন–এ প্রকাশিত সুপ্রিমকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেখা যায়, আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে হাজির করা প্রমাণ কেবল পরিস্থিতিগত, তার বিরুদ্ধে কোনও সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার বস্তুগত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রায়ে বলা হয়, “ওই হামলার ঘটনায় অনেক প্রাণহানি এবং তাকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষোভ তখনই থামবে যখন আসামীকে ফাঁসি দেওয়া হবে।” অর্থাৎ, মিডিয়া ট্রায়াল আর রাজনৈতিক কারণেই স্বাধীন বিচার বিভাগ রায় প্রদান করে।
অরুন্ধতী রায় দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‘আফজাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য কলঙ্ক’ শীর্ষক এক নিবন্ধে সর্বোচ্চ আদালতের রায় এবং আফজালের গোটা বিচারিক প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তিনি বলেন, “গ্রেফতারের সময় জব্দ করা একটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। তবে আইন অনুযায়ী সেগুলো সিলগালা করা হয়নি। বিচারের সময় ফাঁস হয়ে যায় যে, ল্যাপটপের হার্ডডিস্কে গ্রেফতারের পরও হাত দেয়া হয়েছে। তাতে দেখানো হয়, সংসদ ভবনে প্রবেশের সময় ভুয়া অনুমতিপত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং আফজাল তার সব তথ্য মুছে ফেলেছেন।”
অরুন্ধতী প্রশ্ন তোলেন, “পুলিশ কিভাবে আফজালকে গ্রেফতার করেছিল? পুলিশ বলেছিল, গিলানির সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। তবে পুলিশি রেকর্ডে দেখা যায়, গিলানিকে গ্রেফতারের আগেই আফজালকে গ্রেফতার করা হয়। হাইকোর্ট একে স্ববিরোধী বললেও এ বিষয়টি আর সামনে আসেনি।”
তিনি আরো বলেন, “আফজাল গুরুর সত্যিকার কাহিনী ও ট্র্যাজেডি শুধু আদালতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, প্রকৃত ঘটনা জানতে হলে কাশ্মীর উপত্যকার ঘটনা জানতে হবে। এটি একটি পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকায়িত এলাকা। এখানে রয়েছে ভারতের পাঁচ লাখ সৈনিক। প্রতি চারজন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে একজন সৈন্য! আবু গারিব কারাগারের আদলে এখানকার আর্মি ক্যাম্প ও টর্চার সেন্টারগুলোই কাশ্মীরিদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বার্তাবাহক। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে সংগ্রামরত কাশ্মীরিদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজার মুক্তিকামীকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ হাজারকে গুম করা হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছেন আরও অন্তত এক লাখ মানুষ।”
সাম্প্রতিক এক লেখায় বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী বিশ্লেষক সব্যসাচী গোস্বামী বলেন, “দেশপ্রেমী কারা? যারা আইন আদালতের তোয়াক্কা না করে বারবার নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে? আদালতে বিচারাধীন বন্দীকে আদালত দোষি সাব্যস্ত করার আগেই তাকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ চিহ্নিত করে শারীরিক নিগ্রহ করতে উদ্যত হয়েছে? এমনকি খুন করবার হুমকি দিচ্ছে?? ‘ধোলাই’ দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলছে? আদালতে বিচারাধীন মামলার তোয়াক্কা না করে এ দেশের ঐতিহ্যশালী মসজিদকে ভেঙে দিয়েছে? ধর্মের নামে পরধর্মের মানুষকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে? যারা সংখ্যালঘু নারীর পেট চিরে গুজরাটে গর্ভের সন্তানকে বের করে এনে তলোয়ারের ডগায় নাচিয়েছে? এরা দেশপ্রেমিক? এর নাম দেশপ্রেম?…
“…‘আজাদি’ শব্দটার একটা বৃহত্তর পরিসর আছে। জেএনইউ বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’–র পাশাপাশি যখন বলেন ‘মনুবাদ সে আজাদি’, ‘পুঁজিবাদ–সামন্তবাদ সে আজাদি’, ‘মেহেঙ্গাই সে আজাদি’ আবার ‘গিলানি মাঙ্গে আজাদি’ তখন আমরা দেখি ‘আজাদি’ শব্দটার প্রকৃত অর্থেই একটা বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাচ্ছে। ‘আজাদি’ মানে তো ‘মুক্তি’! ‘আজাদি’ মানে তো ‘স্বাধীনতা’। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা! তা এই ‘আজাদি’ শব্দে ভারতের শাসকদের এত ভয় কেন? আজ তো বরং আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে, কেন, কোন্ পরিস্থিতিতে রোহিত ভেমুলা কিংবা অনিকেত আম্ভোরে কিংবা পশ্চিমবঙ্গে চুনিকোটালরা স্রেফ দলিত কিংবা আদিবাসি আত্মপরিচয়ের কারণে লাঞ্ছনা সহ্য করতে করতে একসময় আত্মহত্যার পথে বেছে নিতে বাধ্য হয়? কেন কাশ্মীরের মায়েরা তাদের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়া সন্তানদের খুঁজে পায় না? কেন মনিপুরের মায়েদের সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারের সামনে গিয়ে নগ্ন হয়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে বলতে হবে ‘ইন্ডিয়ান আর্মি রেপ আস’? কেন ইরম শর্মিলা চানুর মতো একজন কবিকে দশক অতিক্রান্ত সময় ধরে অনশন চালিয়ে দাবী জানাতে হয়, ‘আফস্পা আইন বাতিল করো’।
“ঘটনা এটাই যে স্মৃতি ইরানীরা একদিন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে কিন্তু রোহিত ভেমুলারা চিরদিন বেঁচে থাকবেন। জোর করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলে পরেই যদি সব শেষ হয়ে যেত তাহলে রোহিত ভেমুলার মৃত্যুর পর দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ছাত্র–ছাত্রী–শিক্ষক–শিক্ষিকারা তাঁর মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হ’ত না। বলত না এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক খুন! আফজাল গুরুর ফাঁসির বিরুদ্ধেও আজো মানুষ তাহলে সোচ্চার হ’ত না! বলত না এটা একটা জুডিশিয়াল মার্ডার! আর ওই ‘দেশপ্রেমিক’দের চিরকাল তাড়া করে বেড়াবে ওইসব ‘দেশদ্রোহী’–দের ভূত!”
আট.
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী কৌশলে ভারতীয় উপমহাদেশকে দ্বিখণ্ডিত করে জন্ম নেয় পাকিস্তান আর ১৫ আগস্ট ভারত। কোনো রাষ্ট্র যখন ঔপনিবেশিক কাঠামোয় গড়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহকে (যেমন– সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা বাহিনী, প্রশাসন) প্রায় অপরিবর্তিত রেখে নিজেকে স্বাধীন–সার্বভৌম বলে ঘোষণা করে, অখণ্ডতার বুলিতে জাতীয়তাবাদের গান শোনায়, তখন সেটি গণতন্ত্রের লেবাস ধরলেও, তা কখনোই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হতে পারে না। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান বা ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলো তেমনি নির্বাচনসর্বস্ব পোষাকি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাতে জনগণের নাম ভাঙিয়ে শাসকশ্রেণীর গণ–নিপীড়ন বলবৎ থাকলেও জনগণের গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন থাকে সুদূর পরাহত। আর তার ওই বৈশিষ্ট্যসমূহ গড়ে ওঠে ঔপনিবেশিক ছত্র–ছায়ায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের জাতি–সমস্যার বিষয়টিও বেশ জটিল। আর এই সমস্যার জট এতো সহজে ছাড়ানো সম্ভব নয়। তবে এই পাকানো জটটির নানাদিক যথাযথভাবে অনুধাবন করার জন্য প্রয়োজন দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। ‘ভারতীয় জাতি’ নামক ভারতের দালাল–বুর্জোয়া শাসকশ্রেণী প্রসূত তত্ত্বটিকে বোঝাটা খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে “ভারতীয়তা” ও ‘ভারতীয় জাতি’–র মধ্যকার পার্থক্য অনুধাবন করা দরকার। ‘ভারতীয়তা’–র সংজ্ঞায় এই উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তা ও জনগণের প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণে যে কিছু সাধারণ ঐতিহ্য রয়েছে তাকে আবদ্ধ করা যায়। কিন্তু তা কোনো নির্দিষ্ট জাতিসত্তাকে নির্দেশ করে না। রাষ্ট্রীয়তার ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞার মাধ্যমে কেবলমাত্র বোঝানো যায়– ভারত রাষ্ট্র ও তার সংবিধানের আওতাভুক্ত নাগরিকত্ব।
আদর্শ আধুনিক রাষ্ট্র হলো– এক ভাষা, এক ভূখণ্ড, এক জাতি ভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র, যার অর্থনীতি– পুঁজিবাদী অর্থনীতি। পুঁজিবাদের উত্থানকালে এটাই ছিল স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখানে মানুষ দুই শতাধিক ভাষায় কথা বলে। আর এখানে ততোধিক জাতিসত্তারও নিদর্শন পাওয়া যায়। প্রখ্যাত ব্রিটিশ অধ্যাপক টয়েনবি ১৯৫২ সালে লন্ডনে বিবিসি–র উদ্যোগে প্রথম Reith বক্তৃতামালা ‘The World and the West’ দেওয়ার সময় সর্বশেষ বক্তৃতায় (The Psychology of Encounters) বলেন, “উন্নত, স্বতন্ত্র সমাজব্যবস্থার সামাজিক–সাংস্কৃতিক জীবন ও চেতনা উদ্ভূত কোনো জোরালো ধারণা যখন একটি অপরিচিত সমাজদেহে অনুপ্রবেশ করে, তখন তার প্রতিক্রিয়া নতুন অভাবিত পথে ঘটে।” ভারতে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের ধারণাও সেরকমই। ভৌগোলিক–আর্থ–সামাজিক–সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে এটি ইউরোপীয় জাতি–রাষ্ট্রের ধারণায় যেতে পারে না। কিন্তু তাকে সে পথেই নেওয়া হলো জোরপূর্বক।
ভারতের শাসকশ্রেণীর নেতারা উপনিবেশ পর্ব এবং স্বাধীনতা পর্বের শুরুর দিকে জাতিসত্তা এবং জাতি–বর্ণ নিয়ে অনেক অধিকারের কথা বললেও, পরবর্তীকালে সেদিকে আর ফিরেও তাকায়নি। এক শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের দিকেই তাদের নজর ছিলো বেশি। তাই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো, তারা সেই ক্ষমতাকে আরো বৃদ্ধি করতে উদ্যোগ নেন। ভারতের সংবিধানকে আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় মোড়ক দেওয়া হলেও, সেখানে কেন্দ্রকে সর্বতো প্রাধান্য দেওয়া হয়। অঙ্গরাজ্যের ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায় অনেকটা কেন্দ্রের আজ্ঞাধীন এজেন্ট হিসেবে।
‘ভারতীয় জাতি’ নামক একটি মেকি, অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তাকে সাধারণ মানুষের ওপর চাপাচ্ছে সেখানকার শাসকশ্রেণী এবং তাদের চালিত কর্পোরেট প্রচারযন্ত্র। অথচ রাষ্ট্রীয়তা বা নাগরিকত্বকে জাতিগত ক্ষেত্রে কোনোভাবেই টানানো সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়– ১৯৪৭ সালের আগে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছিল ভারতের সঙ্গে একীভূত, কিংবা কয়েক বছর আগেও সিক্কিম ছিল ভারতের বাইরে। প্রতিবারই রাষ্ট্রীয় সীমানা পরিবর্তনের সাথে সাথে কী ভারতীয় জাতির রূপ পালটে গেছে? আমরা জানি, তা কখনোই ঘটে না। তেমন হলে, বাংলাদেশের অধিবাসীদের জাতীয়তা তিনবার পাল্টে যেতো– ভারতীয় থেকে পাকিস্তানি হয়ে বাংলাদেশী। অথচ তা হলো রাষ্ট্রীয়তা বা নাগরিকত্বের বিষয়। রাজনৈতিক পরিভাষা শ্রেণী স্বার্থের কারণে খুশিমতো দাঁড় করালেও বাস্তব সত্য হলো– বাংলাদেশে বাঙালি, চাকমা, মারমা, সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের আবাস রয়েছে; যাদের রাষ্ট্রীয়তা, নাগরিকত্ব বাংলাদেশী। ভারতের ক্ষেত্রে অন্যান্য জাতিসত্তার কথা সাংবিধানিকভাবে আংশিক স্বীকার করে নিলেও ওই জাতীয়তার সংজ্ঞায় একই ধাঁচে রাষ্ট্রীয়তা বা রাষ্ট্রবাদকে জাতীয়তাবাদ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। যেখানে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটিকে উগ্র–জাতীয়তাবাদী তৎপরতায় ধামা–চাপা দেওয়া হয়।
এই উগ্র–জাতীয়তাবাদের মাঝেই নিহিত শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্য। তবে উগ্র–জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে পরিণত হওয়ার পূর্বশর্ত হলো– সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া পুঁজির সঙ্গে তার সংযুক্তি। কখনো এই ফ্যাসিবাদের আত্মপ্রকাশ ঘটে কথিত সেক্যুলারিজমের নামে, আবার কখনো তার প্রকাশভঙ্গী হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের লেবাসে।
অরুন্ধতী রায় নির্বাচনসর্বস্ব কথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ফ্যাসিবাদের উত্থানের পথ বলেই মনে করেন। এই ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তিনি বলেন, “গণতন্ত্র কী? নরেন্দ্র মোদিকে শয়তান ভাবার বিষয় নয় এটা, কেননা গণতন্ত্রের মাধ্যমেই তো আরও আরও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাচ্ছে। মোদিরা জানে যে, গণতন্ত্রের সঙ্গে অধিকাংশের দাপটের সম্পর্ক রয়েছে, আর অধিকাংশের নামে শাসনের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ফ্যাসিবাদের। মোদি ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ। তিনি সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে জনগণের একটা অংশকে একত্রিত করে নিজের লোক বানিয়েছেন। তিনি কর্পোরেটকে হাতে তুলে খাইয়েছেন। নাৎসি যুগে জার্মানিতেও ঠিক এ রকমটাই ঘটেছিলো। ফ্যাসিবাদ ও বড় কর্পোরেশনের সম্পর্ক সুবিদিত। টাটা, রিল্যায়েন্স এবং অন্যান্য কর্পোরেটরা বলছে, গুজরাট হলো পুঁজিপতিদের স্বপ্নের গন্তব্য।
“রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) একটি সাংস্কৃতিক চক্র, বিজেপি যার রাজনৈতিক শাখা। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইতালীয় ফ্যাসিস্ট নেতা মুসোলিনির আদর্শে। তার পর থেকে কখনো গোপনে, কখনো প্রকাশ্যে তা কাজ করে আসছে। তারা খোলাখুলিভাবে ঘোষণা করে যে, জার্মানিতে ইহুদিরা যেমন, ভারতে মুসলিমেরা তেমন। ভারতীয় অনেক উদারতাবাদী একে ফ্যাসিবাদী মনে করেন না, কারণ ফ্যাসিবাদের সঙ্গে তাঁরা দিব্যি খাপ খাইয়ে নেন। হিটলারের সঙ্গে তুলনা করায় মোদির কিছু যায় আসে না। তাঁর ভাষায়, ‘সেটা গ্রহণযোগ্য’। গুজরাটের বাস্তবতায় এবং সেখানকার পাঠ্যপুস্তকে হিটলার খুবই নন্দিত হন।
“সুতরাং গুজরাটে আমরা যা দেখছি, তা এক ধরনের ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদী একনায়ক এক জিনিস আর কোটি কোটি মানুষকে ঘৃণায় মাতিয়ে ভোটে বিজয়ী ফ্যাসিবাদী আরেক জিনিস। এখন গুজরাট চালাচ্ছে লাখো খুদে মোদি। সে সময় যে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেছেন তিনি এখন গুজরাটের পুলিশ কমিশনার। অপরাধীরা স্বীকার করেছে কীভাবে কার মদদে তারা জীবন্ত মানুষ পুড়িয়েছে, কীভাবে মানুষকে টেনে টেনে ছিঁড়েছে, কীভাবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করেছে। এসবের টেপ প্রকাশ করেছে তেহেলকা পত্রিকা, টেলিভিশনে তাদের সেই স্বীকৃতি প্রচারিতও হয়েছে।”
এই লেখাটি ২০০৮ সালের। তখন নরেন্দ্র মোদি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। আর এখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আর কথিত সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের কথিত সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে জয়ী হয়েই তিনি মসনদে আসীন হয়েছেন।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন–এর তাহির মেহেদির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নির্বাচনে বিজেপির জয়লাভ এবং তাতে বিদেশি পুঁজির প্রভাব সম্পর্কে অরুন্ধতী বলেন, “ভারতে ১৯৯১ সালে বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে করে ভারত রাতারাতি বৈশ্বিক পুঁজির স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়, এর অর্থনীতি দ্রুত চাঙ্গা হয়ে ওঠে। অবশ্য নব্য–উদারবাদের ‘রোলার কোস্টার রাইড’টি অপ্রত্যাশিত কিছু বাধার মুখে পড়ে। ২০১০ সালে আকাশছোঁয়া ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি চুপসে গিয়ে গত তিন বছর ধরে পাঁচ শতাংশের নিচে অবস্থান করতে থাকে। কর্পোরেটগোষ্ঠী এই বিপর্যয়ের পুরো দায় চাপায় ক্ষমতাসীন কংগ্রেস পার্টির ‘নীতি নির্ধারণে স্থবিরতা’র ওপর। ‘ভদ্র’ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এখন বাধা হিসেবে চিহ্নিত হলেন। ফলে আগ্রাসী মোদি তার চূড়ান্ত বিপরীত হিসেবে গণ্য হলেন।”
কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদের আরেক নয়া–কৌশল হলো– বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বা স্পেশাল ইকনোমিক জোন (সেজ– SEZ); যা প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment) এফডিআই–এর প্রধানতম বাহক। এটি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন, বা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (EPZ) থেকে অনেকাংশেই পৃথক। ইপিজেড–এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো– রপ্তানি মারফৎ বিদেশী মুদ্রা অর্জন করা। একই সঙ্গে বিদেশী বাজারের প্রয়োজনে বিশেষ ক্যাটাগরির শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা। সরকার সেখানে কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির উপর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেওয়া বা কোনো ধরনের শুল্ক ধার্য না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে; রপ্তানি আয়ের লাভের উপরও আয়কর মওকুফ করে দিতে পারে। অপরদিকে, সেজ অঞ্চলে থাকে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ; যার মাধ্যমে এই বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লভ্যাংশ থাকে কর্পোরেশনের হাতে, তা পুনঃবিনিয়োগ করার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না, শিল্পাঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় থাকতে হবে উন্নত পরিকাঠামো। যেখানে বাসস্থান, স্কুল–কলেজ, স্বাস্থ্য, বিনোদন ইত্যাদি সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা থাকবে, থাকতে হবে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, টেলি–যোগাযোগ ইত্যাদির ব্যবস্থাও। পাশাপাশি শিল্পায়নের জন্য এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে কোম্পানি আইন, কর, পরিবেশ ও শ্রম সংক্রান্ত আইনাবলী একটি কাঠামোতেই ফয়সালা করা যায়। যেখানে সরকারি প্রশাসনের নজরদারি ও দীর্ঘসূত্রতা থাকবে না। এক কথায়, সেজ এলাকায় গড়ে উঠবে কর্পোরেশনের পৃথক শাসনব্যবস্থা। আর এতে ক্রমেই রোল মডেল হয়ে উঠছে ভারত। নয় শতাধিক সেজ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে ভারত সরকার; আর তা বাস্তবায়নে জল–জঙ্গল–জমিন দখলের নগ্ন গণ–নিপীড়নে লিপ্ত হয়ে পড়েছে সেখানকার কর্পোরেট–পুষ্ট ডান–বাম নির্বিশেষে শাসকশ্রেণীর সকল অংশ। নিপীড়িত জনগণ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মাওবাদীদের কাছ থেকে এই গণ–নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ আসে। আর এ কারণে ভারত সরকার অভ্যন্তরীণভাবে মাওবাদীদের সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করে। মূলত এর প্রেক্ষিতেই ভারত রাষ্ট্র ‘অপারেশন গ্রীন হান্ট’–এর মাধ্যমে জনগণের ওপর এক অঘোষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়; যা এখনো চলমান। আর এর মূলে রয়েছে কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদ–নয়া–উপনিবেশবাদ। এরই ধারাবাহিকতায় কর্পোরেশনগুলো ভারতের গত নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি–র পেছনে অবাধে টাকা লগ্নি করেছে। কর্পোরেশনগুলোর দরকার এক নৃশংস খুনী, ফ্যাসিবাদীকে; যিনি তাদের জন্য জল–জঙ্গল–জমিন দখল করতে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতেও পিছপা হবে না। আর বর্তমানে সেই কর্পোরেট সৈনিক; ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি থেকে যোগ্য কেউ হতে পারেন কিনা সন্দেহ রয়েছে; যার হাত রঞ্জিত গুজরাট গণহত্যায় শত শত মানুষের রক্তে।
২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে অরুন্ধতী নিউইয়র্ক থেকে জর্জিয়া স্ট্রেইটকে ফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কর্পোরেটগোষ্ঠী নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চাইছে, কারণ বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেস পার্টি প্রতিবাদ আন্দোলনের বিরুদ্ধে যথেষ্ট নির্মম হতে পারছে না।”
তিনি আরো বলেন, “কর্পোরেশনগুলো মোদিকে সমর্থন দিচ্ছে, কারণ তারা মনে করে মনমোহন এবং কংগ্রেস সরকার ছত্তিশগড় বা উড়িশ্যার মতো জায়গায় সেনা আগাসন চালানোর মতো সাহস দেখাতে পারে নি। মোদি একজন ধূর্ত নেতা, যিনি পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী অবস্থান পাল্টাতে পারেন। …উদ্দাম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো হিন্দুত্ববাদী থেকে তিনি কর্পোরেট স্যুট পরেছেন, আর এখন মুখপাত্রের ভূমিকায় থাকার চেষ্টা করছেন।”
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ নির্দেশিত গণতন্ত্রের ফেরি করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্পর্কে অনেক মিথ চালু রয়েছে। আসলেই তা মিথ, কারণ বাস্তবতা ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল প্রজাতন্ত্র (Republic) হিসেবে, সেখানে মার্কিন জনগণের হাতে ক্ষমতা ছিল নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার। সাধারণ জনগণের গণতন্ত্র (People’s Democracy) সেখানে গড়ে ওঠেনি, তবে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের উপস্থিতি ছিল একটা সময় পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো– সেখানে গণতন্ত্রও নাই, প্রজাতন্ত্রও নাই। সেখানে রয়েছে কর্পোরেটোক্রেসি– বৃহৎ কর্পোরেশনসমূহ, সম্পদশালী ধনিকশ্রেণী এবং কর্পোরেট–দালাল সরকারব্যবস্থার মিলিত শক্তি। অর্থাৎ, তা এমন এক ব্যবস্থা যা নিয়ন্ত্রিত ও শাসিত হয় কর্পোরেটদের দ্বারা।
মার্কিন কর্পোরেটোক্রেসিতে, সময় মেপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ঠিকই, তাতে কোনো এক দল শাসন–ক্ষমতাটাও পায়, কিন্তু বাস্তবতা হলো– বৃহৎ কর্পোরেশনসমূহ এবং ধনিকশ্রেণীই এর মূল শাসক। কর্পোরেশনগুলো নির্বাচনে ডেমোক্রেট–রিপাবলিকান দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই প্রচুর অর্থের লগ্নি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হলো বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল নির্বাচন। এই ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থের প্রধান জোগানদাতা হলো বৃহৎ কর্পোরেশনগুলো। বিজয়ী বা বিজিত, কেউ কর্পোরেটোক্রেসির বাইরে যাওয়ার অধিকার রাখে না। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, উভয় উপায়েই কর্পোরেশনগুলো নির্বাচনে প্রার্থীদের আর্থিক জোগান দিয়ে থাকে। কর্পোরেশনগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের বড়মাপের উপঢৌকন দিয়ে থাকে। তারা সরকার থেকে বেরিয়ে আসলে কর্পোরেট লবি হিসেবে নিযুক্ত হন, তারা তাদের কর্পোরেট প্রভুদের স্বার্থে লেজ নাড়ায়। কর্পোরেট স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনেই তারা তখন দেশপ্রেমের ছোঁয়া পায়। আর এর সমর্থনেও রয়েছে ওই কর্পোরেট মিডিয়া। সিনেটর নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে কর্পোরেটরাই অনুমোদন দিয়ে থাকে প্রার্থীদের। আর এতো আয়োজন কেবলমাত্র কর্পোরেট স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন–কানুন, পররাষ্ট্র, অর্থনীতি ও যুদ্ধনীতি নির্ধারণের নিমিত্তে। যুদ্ধ বা সামরিক আগ্রাসনের বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। আর ওই আগ্রাসনও কিন্তু কর্পোরেট স্বার্থেই পরিচালিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ইসরায়েল নামক মধ্যপ্রাচ্য প্রজেক্টের কথা। যা পরিচালিত হচ্ছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের বাজার আর সেখানকার খনিজ সম্পদ কর্পোরেটদের দখলে রাখার জন্য। আর এজন্য ক’দিন পরপরই গাজায় ইসরায়েলি হামলার মাধ্যমে নিজেদের জানান দেওয়ার দরকার পড়ে।
২০১৭ সালে ডেমোক্র্যাসি নাউ–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী ট্রাম্প ও মোদির ফ্যাসিবাদী চরিত্রের পার্থক্য তুলে ধরে বলেন, “ট্রাম্প সামনে এসেছেন একজন বহিরাগত, সন্দেহভাজন ও উপহাসের পাত্র হিসেবে। মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ার দিক থেকে এমনটাই ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে একটা তদন্ত চলছে।
“…আগেও বলেছি, মোদি হলেন আরএসএসের ফসল, যে সংগঠনটা ১৯২৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত কার্যকর। আরএসএসের হাজার হাজার কর্মী রয়েছেন। তাঁদের নিজস্ব বস্তি শাখা, নারী শাখা, প্রকাশনা শাখা, নিজস্ব স্কুল, বই, নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে। সংগঠনটির লোকজন সর্বত্র রয়েছে। তাঁদের আন্দোলন মাটি থেকে উঠে আসা। আপনাকে তাঁদের সে হিসেবেই মূল্যায়ন করতে হবে। তাঁরা অন্তহীনভাবে কাজ করেছেন। তাই একজন বহিরাগতের সম্পূর্ণ বিপরীত হলেন মোদি। তিনিই বর্তমানে আরএসএসকে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
“…ট্রাম্পকে উপহাস করা, অথবা মোদির বিষয়ে কিছু বলাটা আমার কাছে জরুরি নয়। আসল প্রশ্নটা হলো, কেন তারা? আমরা এই বিষয়টাকে বাদ দিতে পারি না যে, তাঁরা গণতান্ত্রিকভাবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন। তাহলে এই পথে আগুন আছে। আর সেটাই হলো সমস্যা। আপনি জানেন, তাঁরা দুজনেই সহজ খাদ্য। তাঁদের নিয়ে হাসাহাসি করাটা সহজ, কিন্তু আমি মনে করি না বিষয়টা আদৌ হাস্যরসের।
তবে অরুন্ধতী কংগ্রেস এবং বিজেপিকে সমান্তরাল বলেই মনে করেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “কংগ্রেস সব দরজা খুলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আর এখন সে নিজেই জ্বলছে, আমরা তাদের বিকল্প হিসেবে দেখতে পারি না। নিজেদের ধ্বংসের জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। তারা নিজেরাই নজরদারি দল বানিয়েছে। তারা নিজেরাই সাম্প্রদায়িক অগ্নিকাণ্ডের জন্ম দিয়েছে। তারা এদের (বিজেপি) ‘বি’ টিম মাত্র। ”
এর আগে ২০১৪ সালে জর্জিয়া স্ট্রেইটকে অরুন্ধতী বলেন, “কংগ্রেস সবসময় একটু বেশি সেক্যুলার অবস্থান নেয় এবং মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান এসব সংখ্যালঘুদের জন্য যারা আরেকটু বেশি সুবিধা চায়, তাদের দ্বারা সমর্থিত হয়। আমেরিকার বিবেচনায় কংগ্রেস ডেমোক্রেটিক পার্টির মতো। বিজেপি হলো ডানপন্থী দলগুলির কোয়ালিশন এবং তারা জোর করেই প্রতিষ্ঠা করতে চায় ভারত হলো একটি হিন্দু রাষ্ট্র। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দলটি সবসময়ই কঠোর ভূমিকা পালন করে। এভাবে বিবেচনা করলে বিজেপিকে ভারতের রিপাবলিকান হিসেবে দেখা যেতে পারে।
“…বিজেপির বিপরীতে কংগ্রেসের বড় কোনো পার্থক্য নেই। আমি প্রায়ই বলি, যেটা বিজেপি দিনে করে, সেটাই কংগ্রেস করছে রাতে। তাদের অর্থনৈতিক নীতিতে মূলগত কোনো পার্থক্য নেই।
“…যেখানে বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী নিধনযজ্ঞকে ঢালাওভাবে মদদ দিচ্ছিল, ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে দিল্লিতে শিখদের উপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডে কংগ্রেস একই ধরনের ভূমিকা পালন করেছিল।”
নয়.
‘ক্যাপিটালিজম অ্যা ঘোস্ট স্টোরি’ প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে কীভাবে ফাউন্ডেশনগুলো ভারতের নারী অধিকার সংস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিজেদের ইচ্ছেমতো নীতি–নির্ধারণ করছে। দেখানো হয়েছে কীভাবে ভারতে ‘দলিত’ সম্প্রদায় থেকে স্কলার নির্বাচিত করা হয়। উদাহরণ হিসেবে অরুন্ধতী দেখিয়েছেন, রিলায়েন্স গ্রুপের অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের একটি নির্ধারিত লক্ষ্য আছে। তা হলো, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পক্ষে ঐকমত্য অর্জন করা। অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন পারমাণবিক, বায়োলজ্যিকাল এবং রাসায়নিক হুমকির পাল্টা ব্যবস্থা কী হবে তা নির্ধারণ করে। এই ফাউন্ডেশনের সহযোগীদের মধ্যে আছে রেথিওন এবং লকহিড মার্টিনের মত অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
মার্কিন কর্পোরেট শাসিত গণতন্ত্রের সঙ্গে সাদৃশ্য টেনে অরুন্ধতী ‘ক্যাপিটালিজম অ্যা ঘোস্ট স্টোরি’ প্রবন্ধে বলেন যে, রকফেলার ফাউন্ডেশন এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্ট, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ) মাধ্যমে কর্পোরেট স্বার্থে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। এরই আদলে এখন ভারতীয় কোম্পানিগুলি জনগণের এজেন্ডা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দাতব্য ফাউন্ডেশনগুলির মাধ্যমে অর্থ বিতরণ করছে। এই পদ্ধতিকে অরুন্ধতী ‘পারসেপশন ম্যানেজমেন্ট’ বা ‘উপলব্ধির জায়গা নিয়ন্ত্রণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই পদ্ধতির মধ্যে পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চ্যানেলিং ফান্ড প্রদান, চলচ্চিত্র এবং সাহিত্য উৎসব এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদান, পুরস্কার ও বৃত্তি প্রদান। টাটা গ্রুপ গত কয়েক দশক ধরে এসব কথিত কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) চালিয়ে আসছে। আর এখন তার অসুরণ করছে অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থাগুলো। অরুন্ধতী জানান, ওই কথিত সিএসআর–এর মূল উদ্দেশ্য আসলে অসমতা বাড়িয়ে তোলা নয়া–উদারবাদী নীতির সমালোচনাকে চাপা দেওয়া। তারা কী কী কাজ করতে হবে, তা নির্ধারণ করে। তারা জনগণের চিন্তা–ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে জনগণের জন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্যখাত এবং শিক্ষাখাতের টাকা সেসব খাত থেকে বাদ পড়ে যায়। এসব বড় বড় কর্পোরেশনগুলো এনজিওদের ফান্ড দিয়ে এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ঔপনিবেশ আমলে মিশনারিগুলো যা করতো, তেমনটাই করছে। তারা নিজেদের দাতব্য সংস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু তারা আসলে পৃথিবীকে কর্পোরেট–পুঁজির মুক্ত বাজারে পরিণত করার কাজটা করে।
মুকেশ আম্বানি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (আরআইএল) নিয়ন্ত্রণকারী অধিকাংশ শেয়ারের অধিকারী। তাঁর প্রকাশ্য ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্য আজ ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ৪৭ বিলিয়ন ডলার বাজার মূলধনের রিলায়েন্স পেট্রোকেমিক্যালস, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, পলিস্টার ফাইবার, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও উপকরণ, লাইফ সায়েন্সেস গবেষণা ও স্টেম সেল স্টোরেজ সার্ভিসেসের মতো বৈশ্বিক ব্যবসায় জড়িত। রিলায়েন্স কিছুদিন আগে ইনফোটেলের ৯৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। এই টিভি কনসোর্টিয়ামটি খবর ও বিনোদন মাধ্যমসহ যে ২৭টি টেলিভিশন চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ করে, তার মধ্যে রয়েছে সিএনএন–আইবিএন, আইবিএন লাইভ, সিএনবিসি, আইবিএন লকম্যাট এবং প্রায় বিভিন্ন স্থানীয় ভাষায় ইটিভি। ইনফোটেল ফোর–জি ব্রডব্যান্ডের জাতীয় লাইসেন্সের মালিক। আম্বানি আইপিএল–এর একটি ক্রিকেট দলেরও মালিক। আর সম্প্রতি যোগ হয়েছে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের নতুন ব্র্যান্ড ‘জিও’।
এটা কেবল এক মুকেশ আম্বানির কথা না। একইভাবে ভারতের বৃহত্তম গ্রুপ টাটার কথা বলা যেতে পারে। দেশটির লোহা আকরিক খনি, স্টিল প্রস্তুতকারী প্ল্যান্ট, আয়োডাইজড লবণ, টেলিভিশন, গাড়ি নির্মাণ শিল্পের একটা বড় অংশ তাদের দখলে। তারা মানবাধিকার কর্মীদেরও তহবিল দেয়। পার্লামেন্টে রয়েছে লোহা আকরিক ও স্টিল কোম্পানি জিন্দালের সিইও নবীন জিন্দাল। তিনি ফ্ল্যাগ ফাউন্ডেশন মাধ্যমে বাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়ানোর অধিকার অর্জন করেছিলেন।
অরুন্ধতী বলেন, “ফাউন্ডেশনের ফান্ড পাওয়া এনজিওগুলো জনগণের আন্দোলন নষ্ট করে দেয়। রাজনৈতিক ক্রোধকে নিঃশেষ করে এবং তাদেরকে কোনো কানাগলিতে নিয়ে যায়। নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করে রাখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা পুরনো ঔপনিবেশিক খেলা, আর বহুধা বিভক্ত সমাজের কারণে ভারতে এ খেলাটা খুব সহজ।”
“…এখানে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে সাধারণ একজন মানুষ ন্যায়বিচার আশা করতে পারে। কোনো স্থানীয় আদালতেও না, কোনো স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতিনিধির কাছেও না। সবগুলো প্রতিষ্ঠান ভেতর থেকে শূন্য, শুধু বাইরের আবরণটা রয়েছে। সুতরাং নির্বাচনের এই উৎসবের সময়ে সবাই নিজেদের ভেতরের ক্ষোভটাকে বাইরে বের করে দিয়ে ভাবতে পারে, তাদের জীবন নিয়ে তাদের কিছু বলার আছে। কর্পোরেশনগুলোই প্রধান দলগুলোকে ফান্ড দেয় এবং তাদের কাজ নির্ধারণ করে দেয়।”
অরুন্ধতী নয়াউদারনৈতিক ধারণায় এনজিও ও কর্পোরেশনপুষ্ট নারীবাদ ও মানবাধিকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ‘ক্যাপিটালিজম অ্যা ঘোস্ট স্টোরি’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, “ন্যায়বিচারের ভাবনাকে মানবাধিকারের শিল্পে রূপান্তরিত করাটা একটি ধারণাগত ক্যু, যাতে এনজিও এবং ফাউন্ডেশনগুলো গুরূত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানবাধিকারকে সংকীর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার ফলে নৃশংসতাভিত্তিক বিশ্লেষণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে করে ঘটনার বৃহত্তর চিত্রটি বাধাগ্রস্থ হয় এবং সংঘাতে লিপ্ত উভয় পক্ষকেই– যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মাওবাদী ও ভারত সরকার কিংবা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও হামাস– ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী’ হিসেবে ধিকৃত করার প্রয়াস পাওয়া যায়। এতে করে ভূমি হাতানো খনি কর্পোরেশন বা ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের সম্প্রসারণের ইতিহাসটুকু আলোচনায় সামান্য গুরুত্ব বহনকারী ফুটনোটে পরিণত হয়। মানবাধিকারের কোনো গুরুত্ব নেই– এমনটা কিন্তু বলা হচ্ছে না। এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে আমরা যে বিশ্বে বসবাস করছি, তার মহাঅবিচার দেখা বা সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উপলব্ধি করার জন্য এটা যথেষ্ট ভালো মাধ্যম নয়।
“নারীবাদী আন্দোলনগুলোর সঙ্গে ফাউন্ডেশনগুলোর সম্পৃক্ততা আরেকটি ধারণাগত ক্যু। ভারতের বেশিরভাগ ‘ঘোষিত’ নারীবাদী ও নারী সংগঠনগুলো কেন অন্যান্য নারীবাদী সংগঠন, যেমন ৯০ হাজার সদস্যবিশিষ্ট ‘ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন’ (রেভ্যুলশনারি আদিবাসী ওম্যান্স এসোসিয়েশন)- থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে? ‘ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন’ একইসঙ্গে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে পুরুষতন্ত্র এবং দণ্ডাকারণ্যে খনি কোম্পানিগুলো যে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে– সেটাই কি এই দূরত্বের কারণ? লাখ লাখ নারী যেখানে নিজের মালিকানাধীন ভূমিতে কাজ করতো, মালিকানা কেড়ে নিয়ে তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করাকে কেন নারীবাদী সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, বলতে পারেন?
“তৃণমূল পর্যায়ের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও পুঁজিবাদবিরোধী গণআন্দোলনগুলো থেকে উদার নারীবাদী আন্দোলনের সম্পর্ক ছিন্ন করাটা ফাউন্ডেশনের অশুভ কৌশলের মাধ্যমে শুরু হয়নি। বরং, ১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে নারীদের মধ্যে দ্রুতগতিতে যে প্রগতির ধারণা বাড়ছিল, সেই ধারণার সাথে ঐসব আন্দোলনগুলো খাপ খাওয়াতে এবং মেনে নিতে না পারায় এই বিচ্ছেদের সূত্রপাত ঘটে।
“নিজেদের ঐতিহ্যবাহী সমাজে, এমনকী বাম আন্দোলনগুলোর তথাকথিত প্রগতিশীল নেতাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা ও পুরুষতান্ত্রিকতা– ফাউন্ডেশনগুলো অনেক আগেই চিহ্ণিত করতে পেরেছিল। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে নারীদের ক্রমাগত ধৈর্য হারানোর বিষয়টিও তারা সঠিকভাবে বুঝেছিল। ফলে নারীদের প্রতি সমর্থন ও তহবিল যোগান দিয়ে ফাউন্ডেশনগুলো তাদের প্রতিভার পরিচয় দিতে দেরি করেনি। ভারতের মতো দেশে, গ্রাম ও নগরের মধ্যেও উপদলীয় বিভক্তি বিরাজ করে। গ্রামের দিকে যেখানে পুরষতন্ত্র তখনো বেশিরভাগ নারীর জীবন নিয়ন্ত্রণ করতো, সেখানেই অধিকাংশ আমূল পরিবর্তনকামী ও পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল। যে শহুরে নারীরা এ ধরনের আন্দোলনে (নকশাল আন্দোলনের মতো) যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা পশ্চিমা নারীবাদী আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ও উদ্দীপ্ত ছিলেন। যেখানে তাদের পুরষ নেতারা ‘জনগণের’ সাথে মিশে যাওয়াকে একান্তই নিজেদের কর্তব্য বলে মনে করতেন, সেখানে স্বাধীনতার পথে নারীদের এই নিজস্ব যাত্রা প্রায়ই সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াতো। নারীরা তখন প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হতেন। এমনকি তাদের নিজস্ব কমরেডদের দ্বারাও তারা নিগৃহীত হতেন। অনেক নারী কর্মীই ‘বিপ্লব’–এর মাধ্যমে এসব নিপীড়নের অবসান ঘটানোর জন্য অপেক্ষা করতে আর ইচ্ছুক ছিলেন না। তারা চাইলেন, ‘লিঙ্গের সমতা’ কেবল বিপ্লব পরবর্তী প্রতিশ্রুতি হিসেবেই থাকবে না, বরং তা হবে বিপ্লবী প্রক্রিয়ার নিরঙ্কুশ, তাৎক্ষণিক, ও আপসহীন অংশ। তেমনটা না হওয়ায় বুদ্ধিমান, ক্ষুব্ধ, ও মোহমুক্ত নারীরা ক্রমশ আন্দোলন থেকে সরে যেতে থাকেন। অতপর বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এবং টিকে থাকার জন্য তারা অন্যান্য উপায়ের খোঁজ শুরু করেন। এর ফলে ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে যখন ভারতীয় বাজার খুলে দেওয়া হচ্ছিল, তখন ভারতের উদার নারীবাদী আন্দোলন অতিমাত্রায় এনজিওপুষ্ট হয়ে পড়ে। এসব এনজিওর অনেকগুলো সমকামী অধিকার, পারিবারিক সহিংসতা, এইডস, এবং যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে প্রাথমিক কাজ শুরু করে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, যদিও নতুন নতুন অর্থনৈতিক–নীতির দ্বারা নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, তথাপি উদার নারীবাদী আন্দোলনগুলো এসব নীতিকে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাপারে সামনের কাতারে ছিল না। ফলে অনুদান–তহবিল বণ্টনকে কৌশলে কাজে লাগিয়ে ফাউন্ডেশনগুলো ‘রাজনৈতিক’ কার্যক্রমের পরিধি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাপকভাবে সফল হয়। এতে করে তারা এনজিওগুলোর তহবিল দেওয়ার নির্দেশিকার মধ্যে কোনটি নারীদের ‘ইস্যু’ এবং কোনটি নয়, তা চিহ্নিত করে দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
“নারীদের আন্দোলন এনজিওকরণের ফলে পশ্চিমা উদার নারীবাদই (এতে সবচেয়ে বেশি তহবিল থাকার গুণে) নারীবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণের আদর্শ মাপকাঠিতে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে নারীদের দেহটাই হয়ে ওঠে লড়াইয়ের কেন্দ্র। যার একদিকে থাকে বোটোক্স ব্যবহার করে ত্বকে ভাঁজ পড়তে না দেওয়া এবং অন্যদিকে থাকে বোরকা। (আর অনেকে আছে যারা বোটোক্স এবং বোরকার দ্বিমুখী দুর্ভোগ পোহায়।) সম্প্রতি ফ্রান্সে নারীদের নিজেদের ‘পছন্দমতো বেছে নেয়ার’ পরিবেশ সৃষ্টির বদলে তাদের বোরকা থেকে বের হতে বাধ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগটির সাথে নারী মুক্তির কোনো সম্পর্ক ছিল না, বরং এটি ছিল নারীকে নগ্ন করার একটা প্রচেষ্টা। এই ঘটনা অবমাননাকর, আর তা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে। কোনো নারীকে বোরকা থেকে বলপূর্বক বের করাটা তাকে বলপূর্বক বোরকার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়ার মতোই খারাপ। বিষয়টা বোরকার ব্যাপার নয়। এটা বলপ্রয়োগের ব্যাপার। সামাজিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে জেন্ডারকে এভাবে বিবেচনা করাটা– পরিচয় নির্ধারণের ইস্যু তৈরি করে, অবলম্বন এবং পরিধেয় পোশাকের যুদ্ধ শুরু করায়। আর এই ইস্যুটিই মার্কিন সরকারকে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আক্রমণ চালানোর সময় নৈতিক ঢাল হিসেবে পশ্চিমা নারীবাদী গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিল। আফগান নারীরা তালেবান শাসনে মারাত্মক কঠিন অবস্থায় ছিল (এখনো আছে)। কিন্তু তাদের ওপর ‘ডেইজি কাটার’ বোমা ফেলাটা কোনোভাবেই তাদের সমস্যার সমাধান ছিল না।
“এনজিওদের দুনিয়া– যেখানে তারা নিজেদের মতো করে এক উদ্ভট বেদনানাশক ভাষা সৃষ্টি করেছে– সেখানে সবকিছুই একটি ‘বিষয়’ যা একটি পৃথক পেশাদারিত্বের মোড়কে বিশেষ স্বার্থান্বেষী ইস্যুতে পরিণত হয়। সমাজ উন্নয়ন, নেতৃত্ব বিকাশ, মানবাধিকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বংশবিস্তারের অধিকার, এইডস, এইডস আক্রান্ত এতিম– সবই তাদের মনের মতো পূর্ণাঙ্গ ও নিঁখুত তহবিল নির্দেশনাসহ তাদেরই একান্ত গুদামঘরে তারা তুলে রাখে। নারীবাদের মতো দারিদ্র্যকেও প্রায়ই অভিন্ন সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মানবিক ঐক্যকে আর্থিক অনুদানের মাধ্যমে যেভাবে টুকরো টুকরো করা হয়েছে, কেবল নিপীড়ন চালিয়ে তা কখনোই সম্ভব হতো না।
“দারিদ্রকেও নারীবাদের মতো একটি আইডেন্টিটির সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্যাপারটা এমন যেন, কোনো অবিচারের কারণে গরিব মানুষের সৃষ্টি হয়নি, বরং তারা স্রেফ একটি হারানো গোত্র, যারা এখনো টিকে আছে। তাই তাদেরকে স্বল্প মেয়াদে কষ্ট লাঘবকারী ব্যবস্থায় (এনজিওর মাধ্যমে পৃথক পৃথকভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে) উদ্ধার করা সম্ভব এবং তাদের দীর্ঘ মেয়াদী উত্থানের জন্য প্রয়োজন হলো– ‘সুশাসন’। এবং কোনো রকম বিরোধিতা ছাড়াই যদি বৈশ্বিক কর্পোরেট পুঁজিবাদী শাসন কায়েম করা যায়, কেবল তাহলেই শুধু এই ‘সুশাসন’ আনা সম্ভব।
“ভারতকে যখন ‘উজ্জ্বল’ করে দেখানো হচ্ছিল, তখন কিছু সময়ের জন্য ‘ভারতীয় দারিদ্র’ নিঃসঙ্গতার মধ্যে ছিল। তারপর সে অদ্ভূত পরিচয় নিয়ে শিল্পের রাজ্যে ফিরে আসে। আর এই দারিদ্রকে ফিরিয়ে আনার কাজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয় ‘স্লামডগ মিলিওনিয়ার’–এর মতো চলচ্চিত্র। গরিবদের নিয়ে এসব কাহিনীতে তাদের আশ্চর্য প্রাণশক্তি ও ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। তবে কাহিনীতে কোনো ভিলেন নেই। কেবল গল্পে উত্তেজনা এবং স্থানীয় রং ছড়ানোর জন্য ছোট খাটো কাউকে আনা হয়েছে। এসব কাহিনীর লেখকেরা আধুনিক বিশ্বে প্রাথমিককালের নৃবিজ্ঞানীদের সমতুল্য বলে গণ্য হচ্ছেন। প্রকৃত নৃবিজ্ঞানীদের মতো সমান সাহস নিয়ে অজানা পথের দিকে সাহসী যাত্রায় ‘বাস্তব অবস্থা’ নিয়ে কাজের জন্য তাদের কপালে জুটছে প্রশংসা ও সম্মান। গরিবদের নিয়ে এতোসব কাঁটাছেঁড়া হলেও, ধনীদের নিয়ে যে একইভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, তা কিন্তু খুব একটা চোখে পড়ে না!
“সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন, আদালত, মিডিয়া, ও উদার জনমত নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে কাজ করার পর নয়াউদারবাদী মহলের আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা বাকি ছিল। আর তা হলো– ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা তথা ‘জনগণের শক্তি’র হুমকিকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়? এই শক্তিকে কীভাবে বশ মানানো যায়? কীভাবে এই শক্তির বলে বলীয়ান প্রতিবাদীদের পোষ্য করা যায়? কীভাবে জনগণের ক্রোধকে ঝেড়ে–পুছে অন্ধ গলির দিকে ঠেলে দেয়া যায়?”
জর্জিয়া স্ট্রেইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেন, “অল্প কয়েকটি কর্পোরেশন এখন আমাদের মালিক, আর তারাই আমাদের পরিচালিত করে, যারা চাইলেই নিজেদের ইচ্ছেমতো ভারতকে স্থবির করে দিতে পারে।”
সম্প্রতি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে (জেএনইউ) সংঘটিত আন্দোলনেও জি–নিউজের মতো কর্পোরেট মিডিয়াগুলোকে সরাসরি হিন্দুত্ববাদের স্তুতি গাইতে দেখা গেছে। সেখানে বামপন্থী ছাত্রনেতা উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্যদের জয়েশ–ই–মোহাম্মদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আর হিন্দুত্ববাদী মিডিয়ার কথায় পুলিশ ঔপনিবেশিক ‘সিডিশন’ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা দায়ের করে কমরেডদের বিরুদ্ধে। তাদের হাতে প্রমাণ হলো জি–নিউজের এডিট করা ভিডিও! তবে অনেক মিডিয়ার হিন্দুত্ববাদিতার মাঝেও এনডিটিভি (বিশেষত উল্লেখ্য সাংবাদিক রাভীশ কুমারের কথা) বা ইন্ডিয়ান এন্সপ্রেসের মতো কিছু মিডিয়ার প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিলো, তারা সাংবাদিকতাকে অনেকাংশেই সমুন্নত রেখেছেন।
দশ দিন প্রাণভয়ে লুকিয়ে থাকার পর ক্যাম্পাসে ফিরে উমর খালিদ যে বক্তব্য রাখেন, তাতেই তার অবস্থান সুস্পষ্টভাবে বোঝা সম্ভব হতে পারে। জয়েশ–ই–মোহাম্মদের সঙ্গে তাকে জড়ানোর বিষয়ে উমর বলেন, “জয়েশ–ই–মোহাম্মদ যদি শুনতে পায় আমাকে তাদের সদস্য বলা হচ্ছে, তাহলে ওরা বোধ হয় আরএসএস–এর সদর দফতরের সামনে ধর্নায় বসবে। আসলে আমি নিজেকে কখনও মুসলমান মনে করিনি। মুসলমান হিসেবে নিজেকে তুলেও ধরিনি।” তিনি আরও বলেন, “মাই নেইম ইজ উমর খলিদ অ্যান্ড আই অ্যাম নট এ টেরোরিস্ট। …আদিবাসী হলে মাওবাদী আর মুসলমান হলেই সে সন্ত্রাসী– এই ধারণা ঠিক নয়।”
দশ.
অরুন্ধতী রায় তখন দ্বিতীয় উপন্যাসের কাজে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কাজ বেশিদূর এগোনোর আগেই তাঁর কাছে একটি চিরকুট আসে মাওবাদীদের কাছ থেকে, যাদেরকে ভারতের ‘সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকি’ বলে ঘোষণা করেছিল তৎকালীন সরকার। অরুন্ধতী জানান, মাসের পর মাস তিনি মাওবাদীদের জবাবের প্রতীক্ষায় ছিলেন। আর যখন মাওবাদীদের কাছ থেকে জানার এমন সুযোগ আসলো, তখন তাঁকে উপন্যাস লেখা আপাতত স্থগিত রাখতেই হলো। তিনি ছুটলেন দণ্ডকারণ্যের পথে। ২০১০ সালে এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অরুন্ধতী লিখলেন ‘ওয়াকিং উইথ কমরেডস’। কথিত মূলধারার সুশীল সাহিত্যিক, লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবীরা ভারত রাষ্ট্রের মৃদু সমালোচনা করলেও কথিত অখণ্ডতা, শান্তি, সুশাসনের নামে সশস্ত্র বিপ্লবী ধারার কোনো আন্দোলনকে বৈধতা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন সমর্থনে যে কর্পোরেট সমর্থন খারিজ হয়ে যায়! অরুন্ধতী রায় সেই বদ্ধ দেয়াল ভেঙে কর্পোরেশন বা রাষ্ট্রের নয়, জনগণের পক্ষে অবস্থান নেন। আদিবাসী, মাওবাদীদের বিদ্রোহে ন্যায্যতা প্রদান করেন। ভারতের মাওবাদীদের গণমুখী কর্মপদ্ধতির প্রশংসা আর জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া ভারত রাষ্ট্রের অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান ফুটে উঠে ‘ওয়াকিং উইথ কমরেডস’ প্রবন্ধে।
অরুন্ধতী বলেন, “অরণ্যে মুখোমুখি দুই পক্ষের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না। একদিকে রয়েছে বিপুল আধা–সামরিক বাহিনী; যাদের রয়েছে অর্থ, সমরাস্ত্র, মিডিয়া ও এক উদীয়মান পরাশক্তির দম্ভ। অন্যদিকে রয়েছে মামুলি অস্ত্রে সজ্জিত সাধারণ গ্রামবাসী; যাদের পেছনে রয়েছে দারুণ সংগঠিত, প্রচণ্ডভাবে উদ্দীপ্ত মাওবাদী গেরিলাদের লড়াকু শক্তি। রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের লড়াইয়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো– পঞ্চাশের দশকের তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ, ষাটের দশকের শেষ থেকে সত্তরের দশক অবধি পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলাম এবং আবার আশির দশক থেকে অন্ধ্র, বিহার ও মহারাষ্ট্রে তারা মুখোমুখি হয়েছে। এখনো এই লড়াই চলছে। পরস্পরের কৌশল ও যুদ্ধপ্রণালী দুই পক্ষের কাছেই অনেক পরিচিত। প্রতিবারই মনে হয়েছে, মাওবাদীরা কেবল পরাজিতই নয়, একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবারই আগেরবারের চেয়ে সংগঠিত, সংকল্পবদ্ধ ও প্রভাবশালী হয়ে তারা ফিরে এসেছে। আজ আবার তাদের সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের খনিসমৃদ্ধ ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, উড়িশ্যা ও পশ্চিমবঙ্গের অরণ্যে। ভারতের লাখ লাখ আদিবাসীর এই মাতৃভূমি আজ কর্পোরেট জগতের স্বপ্নভূমিও বটে।
“শহুরে সুবোধ ভদ্রলোকদের পক্ষে বিশ্বাস করা সহজ যে, যারা নির্বাচনকে ভাওতাবাজি মনে করে, সংসদকে বলে শুয়োরের খোয়াড়, আর যারা খোলাখুলি ভারত রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করতে চায়– সরকারের সঙ্গে লড়াই চলছে সেই মাওবাদীদের। তারা সহজেই ভুলে যান, মাওয়ের জন্মেরও শত বছর আগে থেকেই মধ্যভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রতিরোধ চালিয়ে আসছে। না লড়লে তারা মুছে যেত। ব্রিটিশ সরকার, জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে হো, ওরাঁও, কোল, সাঁওতাল, মুন্ডা ও গোঁড়রা বারবার বিদ্রোহ করেছে। প্রতিবারই নৃশংসভাবে তাদের দমন করা হয়েছে, খুন হয়েছে হাজারে হাজারে, কিন্তু তারা বশ মানেনি। এমনকি স্বাধীনতার পর প্রথম পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়িতে যে মাওবাদী অভ্যুত্থানগুলো ঘটে, তারও অন্তস্থলে ছিলেন এই আদিবাসীরাই। তখন থেকেই নকশাল রাজনীতি ও আদিবাসীদের প্রতিরোধ একাকার হয়ে গেছে।”
মাওবাদীদের প্রভাবাধীন ভৌগোলিক এলাকা ‘রেড করিডোর’ নামে পরিচিত। এই এলাকার বিস্তৃতি ভারতের নবগঠিত রাজ্য তেলেঙ্গানা থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণদ হয়ে বিহার পর্যন্ত। এছাড়াও তামিলনাড়ু, কর্ণাটকের একাংশ, উড়িশ্যার পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলেও মাওবাদীদের প্রভাব রয়েছে। মাওবাদীদের বিস্তৃতিও ঘটেছে খুব দ্রুত। ১৯৯০ সালে সরকারি হিসেবমতে, ভারতের চারটি রাজ্যের ১৫টি জেলায় মাওবাদীদের প্রভাব ছিলো। ২০০৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় নয় রাজ্যের ৫৫ জেলা এবং ২০০৪ সালে ১৩ রাজ্যের ১৫৬ জেলায়। ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী, ভারতের বর্তমানে জেলার সংখ্যা মোট ৬৮৭টি। ধারণা করা হয়, এখন ১৯ রাজ্যের ২৩০টি জেলায় মাওবাদীরা সক্রিয় রয়েছে। সেই হিসেবে, ভারতের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ জেলায় মাওবাদীদের নিশ্চিত উপস্থিতির কথা কথিত ‘মেইনস্ট্রিম’ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরেই জানা যাচ্ছে।
মাওবাদীদের সংগ্রামের ন্যায্যতা দিচ্ছেন খোদ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং! ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল ছয় মাওবাদ প্রভাবিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি বলেন, “শোষণ, কৃত্রিমভাবে চাপিয়ে দেওয়া যতসামান্য মজুরি, সামাজিক–রাজনৈতিক বৈষম্য, কর্মহীনতা, সম্পদের ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়া, অনুন্নত কৃষিব্যবস্থা, ভূমি সংস্কারের অভাব প্রভৃতি কারণে নকশাল আন্দোলনের বিস্তৃতি ঘটছে।”
সরকারের পক্ষ থেকে ভারতের কৃষি সমস্যাকে ন্যায্যতা দেওয়া এবং ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে সমাধানের উপায় খোঁজা হলেও তা কেবলই কৌশলী বাগাড়ম্বর মাত্র। কারণ এই ব্যবস্থা সামন্ততন্ত্র ও লুটপাটকেন্দ্রিক দালাল–বুর্জোয়াশ্রেণীর স্বার্থকে ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করে চলেছে।
এ সম্পর্কে ২০০৮ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের ‘উগ্রপন্থা অধ্যুষিত এলাকাতে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “স্বাধীনতার পর থেকে উন্নয়নের যে মডেল অনুসরণ করা হয়েছে তার কারণে সমাজের প্রান্তিক মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এই মডেল ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মডেল গরীব মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে অসহিষ্ণু। তাদের জন্য বয়ে তা বয়ে এনেছে উচ্ছেদ, সামাজিক সংগঠনের ধ্বংস, সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সম্পদের ক্ষয় করেছে, আর তাদের শোষণমূলক কাঠামোয় রূপান্তরিত করেছে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন হয়েছে। আর এসব কিছুই ‘আইন শৃঙ্খলার সমস্যা’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর তা দমন করা হয়েছে।।”
এই প্রতিবেদন ও মনমোহন সিংয়ের বক্তব্যে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, ভারত রাষ্ট্র ভোটের অনুপাতে বৃহৎ হলেও গণতন্ত্রের অনুপাতে তা কেবলই লুটপাটকেন্দ্রিক দালাল–বুর্জোয়াশ্রেণী ও নয়া–সামন্ত্রতন্ত্রের মাঝেই সীমিত। ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গণতন্ত্রের চরিত্র ও অনুশীলনেই তার সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটে। আর সেখানেই সমস্যা এবং তার সমাধানটা নিহিত। যে ব্যবস্থায় ন্যায়ের ধারণায় সাধারণ মানুষের কোনো স্থান নেই। তা কেবলই দায়বদ্ধতা লুটপাটতন্ত্রের অংশীদারদের প্রতি।
ভারতের শাসকশ্রেণীর কোনো সরকার এসব সীমাবদ্ধতা নিয়ে মুখ খুললেও তা কাটিয়ে ওঠার পথ দেখাতে অপারগ। কারণ এই শোষণ থেকে বেরিয়ে আসতে দরকার এক সমাজ বিপ্লব। যার মধ্য দিয়ে সূচনা হতে পারে এক মানবিক সমাজের। কিন্তু তা করার দুঃসাধ্য মনমোহন সিং বা তার শ্রেণীগত চরিত্রের নেতাদের থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক।
মোদ্দা কথা হলো– মাওবাদীদের সঙ্গে ভারত রাষ্ট্রের সংঘাত কোন দুটি গোষ্ঠী, বা ব্যক্তির সংঘাত নয়। বরং এই সংঘাত হলো দুটি উন্নয়ন দর্শনের সংঘাত। এখানে পুলিশ বা রাষ্ট্রীয় বাহিনী কয়জনকে মারতে পারলো, অথবা মাওবাদীরা কয়জনকে খতম করলো, তা মূল্যহীন। কে কোন পক্ষ থেকে কোন লক্ষ্যের জন্য লড়ছেন, সেটাই মুখ্য। একদিকে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার লড়ছে কর্পোরেশন, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ–এর পক্ষে, তাদের রাস্তা পরিষ্কার করে আদিবাসীদের উচ্ছেদের জন্য। অপরদিকে, মাওবাদীরা লড়ছেন আদিবাসীদের জল–জঙ্গল–জমিনের অধিকারের পক্ষে, বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ আর কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে। এটাই দুই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির মূল সংঘাত।
১৯৯০–এর দশকে ভারত তার বৃহৎ বাজার কর্পোরেটদের জন্য খুলে দিয়ে সংরক্ষিত শ্রম, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সব আইন নতুন রূপে গড়ে তোলে। সেই সঙ্গে সন্ত্রাস–বিরোধী আইনকে আরো নিপীড়নমূলক আকারে গড়ে তোলা হয়। বেসরকারি ও ব্যক্তি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এতে করে ভারত রাতারাতি কর্পোরেট পুঁজির স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়, এর অর্থনীতি দ্রুত চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বহুজাতিক কয়েকটি কর্পোরেটগোষ্ঠী ভারতের কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানির মাধ্যমে পুরো ভারতের বাজারের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে নেয়।
মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি কর্পোরেশন ভারত পরিচালনা করে তাদের অন্যতম মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (আরআইএল), টাটা, জিনদাল, বেদান্ত, মিত্তাল, ইনফোসি, এসার, আদানি এবং মুকেশের ভাই অনিল আম্বানির মালিকানাধীন অন্য রিলায়েন্স (এডিএজি)। উল্লেখ্য, এই কর্পোরেটরা বৃহৎ বহুজাতিক কংলোমারেটগুলোর সহযোগী হিসেবেই ভারতের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
‘ওয়াকিং উইথ কমরেডস’ প্রবন্ধে অরুন্ধতী রায় বলেন, “রায়পুর থেকে দান্তেওয়াড়া যাওয়ার ১০ ঘণ্টা পথের অঞ্চলটিকে বলা হয় ‘মাওবাদী উপদ্রুত’ এলাকা। উপদ্রব নির্মূল করাই নিয়ম। এভাবে গণহত্যার শব্দ আমাদের ভাষায় ঢুকে পড়েছে। রায়পুরের ঠিক বাইরেই বিরাট এক বিলবোর্ডে বেদান্ত ক্যান্সার হাসপাতালের বিজ্ঞাপন। উড়িশ্যায় এই কোম্পানি (এখানেই একসময় চাকরি করতেন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চিদাম্বরম) যেখানেই বক্সাইটের খনি বানায়, সেখানেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ দেয়। এভাবেই খনি কোম্পানিগুলো আমাদের মনের মুকুরে জায়গা করে নেয়। তাদের এই কৌশলের নাম করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর)- কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই সিএসআরের মাধ্যমেই তারা তাদের অর্থনৈতিক কায়কারবার লোকচুক্ষুর আড়ালে রাখে। কর্ণাটক রাজ্যের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন বলছে, প্রতিটন লোহার জন্য খনি কোম্পানি সরকারকে দেয় ২৭ রুপি আর তাদের লাভ হয় পাঁচ হাজার রুপি। বক্সাইট কিংবা অ্যালুমিনিয়াম খনিতে লাভের হার আরো বেশি। এভাবেই প্রকাশ্য দিবালোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুট হয়ে যাচ্ছে। এই টাকা দিয়েই তারা নির্বাচন, বিচারক, সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, এনজিও ও সাহায্য সংস্থাগুলোকে কিনে রাখতে পারে। তাই কোথাও ক্যান্সার হাসপাতাল দেখলেই আমার সন্দেহ হয়, আশপাশে কোথাও খনি রয়েছে। তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যখন একটি সরকারি প্রতিবেদনেই বলা হয়, ছত্তিশগড়ের সরকারি মদদে গঠিত খুনে বাহিনী সালওয়া জুডুমকে প্রথম অর্থদানকারীদের মধ্যে টাটা স্টিল ও এসার স্টিল অন্যতম।
“আমার পথে পড়লো ব্রিগেডিয়ার বি কে পনওয়ারের বিখ্যাত সন্ত্রাসবিরোধী ও জঙ্গলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ কলেজ। তার কাজ হলো– দুর্নীতিবাজ ও বখাটে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জঙ্গল–কমান্ডো বানানো। প্রতি ছয় সপ্তাহে এখান থেকে ৮০০ পুলিশ সদস্য যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হন। ভারতজুড়ে এ রকম আরও ২০টি কলেজ হচ্ছে। এভাবে পুলিশকে সেনা বানানো হচ্ছে (কাশ্মীরে হচ্ছে উল্টোটা। সেখানে সেনাবাহিনীই করছে পুলিশ ও প্রশাসনের কাজ)। যা–ই করা হোক, তাদের শত্রু হলো জনগণ।”
ভারতের সরকার বা শাসকশ্রেণী যখনই উন্নয়নের কথা বলে, তখনই ওই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মানুষজন অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, তাদের ‘উন্নয়ন’–এর মানে হলো, স্থানীয় জনগণের বাস্তুচ্যুত হওয়া। ওই ‘উন্নয়ন’ কেবলই বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতের দালাল কর্পোরেট ও শাসকশ্রেণীর উন্নয়ন, যারা মূলত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দেশীয় এজেন্ট।
অরুন্ধতী বলেন, “যতবার বড় বাঁধ, সেচপ্রকল্প কিংবা খনি করার প্রয়োজনে বিপুলসংখ্যক মানুষকে সরাতে হয়েছে, প্রতিবারই সরকার ‘আদিবাসীদের মূল ধারায় সামিল’ করা অথবা তাদের ‘উন্নয়নের সুফল’ দেওয়ার কথা বলেছে। ভারতে কেবল বাঁধ বানাতেই তিন কোটি মানুষকে উচ্ছেদ হয়ে যেতে হয়েছে। তারা হলো ভারতের উন্নয়নের উদবাস্তু, আর তাদের বড় অংশই হলো আদিবাসী। তাই যখনই সরকার আদিবাসীদের কল্যাণের কথা বলে, তখনই তারা দুশ্চিন্তায় পড়ে।”
ওই ‘উন্নয়ন’–এর জোয়ারে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশের অবস্থান কথিত দারিদ্র সীমার নিচে। যাদের প্রতিদিনের আয় ২০ রুপির বেশি নয়। কেবল ২০১২ সালেই ভারতে ১৪ হাজার কৃষক আত্মহত্যা করেছে। অপরদিকে, ভারতের ১২০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের এক–চতুর্থাংশই রয়েছে ১০০ জনের দখলে।
মাওবাদীরা বস্তারসহ মধ্যভারতের বিস্ত্রীর্ণ অঞ্চল দণ্ডকারণ্যে ‘জনতন সরকার’ বা ‘জনতার সরকার’ নামে এক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। প্রায় ১ লাখ বর্গ কিলোমিটারের ওই অঞ্চল ভারতের ছয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ এবং ওড়িশ্যায় ছড়িয়ে রয়েছে। ওই অঞ্চলের জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। গোঁড়, কোন্ডারেড্ডি, ওড়িয়া, গুদিজুরসাসহ বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীই ওই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সরকারি বক্তব্য ও মাওবাদীদের দাবি থেকে জানা যায়, দণ্ডকারণ্যের এক বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে মাওবাদীদের গেরিলা তৎপরতা, যেখানে তাদের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ওইসব এলাকায় পার্টি কমিটি, সশস্ত্র গেরিলা প্লাটুন ছাড়াও মাওবাদীরা জনগণের অংশগ্রহণে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ও গণসংগঠন। এর মধ্যে রয়েছে বিপ্লবী গণকমিটি বা রেভলিউশনারি পিপলস কমিটি (আরপিসি), দণ্ডকারণ্য আদিবাসী কিষাণ মজদুর সংঘ (ডিএকেএমএস), ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংঘ (কেএএমএস), গ্রামরক্ষী দল (জিআরডি), ক্রান্তিকারী আদিবাসী বালক সংঘ (কেএবিএস), এরিয়া ডিফেন্স গ্রুপ (এডিজি) ইত্যাদি। দণ্ডকারণ্যের প্রায় সকল এলাকায় এসব সংগঠনের কমিটি রয়েছে।
দণ্ডকারণ্যে ‘জনতন সরকারের’ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূলনীতি নেওয়া হয়েছে চীনা বিপ্লব থেকে। পাঁচশো থেকে পাঁচ হাজার মানুষ বাস করা অঞ্চলে এই জনতার সরকারের একটা করে প্রশাসনিক ইউনিট আছে। ওই এলাকার জনগণই ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করেন তাদের প্রতিনিধি। প্রতিটা ইউনিটের আবার নয়টা বিভাগ আছে। তা হলো– কৃষি, ব্যবসায়–বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিচার, প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা, শিক্ষা–সংস্কৃতি ও বনবিভাগ। কয়েকটা এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় একটা আঞ্চলিক পরিষদ। তিনটা আঞ্চলিক পরিষদ নিয়ে গঠিত হয় একটা বিভাগ। চীন বিপ্লবের মতো ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লব সফলতা পেলে বিপ্লব–পরবর্তী রাষ্ট্র কাঠামোটি কেমন হবে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় মাওবাদীদের এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে।
আদিবাসীদের কৃষিকাজ মূলত আদিম পদ্ধতিতে পরিচালিত হতো। দণ্ডকারণ্যে সবজি চাষ হতো যতসামান্য। ফলের চাষ একদমই দেখা যেতো না। আদিবাসী জনগোষ্ঠী সাধারণত জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা গাছপালার কাণ্ড, ফল–মূল খেয়ে জীবন–ধারণ করতো। আর মাছ, কাকড়া ইত্যাদি শিকার করতো। কিন্তু এতে প্রচুর সময় ব্যয় হতো। মাওবাদীরা সেখানে জঙ্গল রক্ষা করে, আগাছা দূর করে, জৈব চাষ পদ্ধতি প্রয়োগের উদ্যোগ নেন। সেই সঙ্গে সেচ, মাছ চাষ, সবজি ও ফল চাষ, বিপ্লবী সমবায় গঠন, শিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন সমাজের নির্মাণ।
কেবল কৃষিজমি চাষ নয়, পানীয় জলেরও অপর্যাপ্ততা দূর করতে জলাধার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পানীয় জলের জন্যও সেখানকার অধিবাসীদের কয়েক মাইল হেঁটতে হতো। এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতো গ্রীষ্মকালে, যখন খরা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতো। কিন্তু এসব বিষয়ে নজর দেওয়াটা ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কথিত উন্নয়ন কর্মসূচীর মধ্যেই ছিলো না, অথবা এসব বরাদ্দ উপরতলাতেই লুটপাট হয়ে যেতো! কিন্তু মাওবাদীদের সামনে জলাধার নির্মাণের বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক গণদাবি।
‘জনতন সরকারের’ উন্নয়নমূলক কাজের ভিত্তি হলো স্বেচ্ছাশ্রম। আর এর ভিত্তিতেই উদ্যোগ নেওয়া হয় জলাধার নির্মাণের। আর এ কাজের প্রাথমিক শর্ত ছিল জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা দৃঢ় করা। আর ব্যাপক প্রচারণার মধ্য দিয়ে জনগণকে নিজের স্বার্থেই সামষ্টিক উন্নতির জন্য উৎসাহিত করে তোলা হয়।
১৯৯৮ সালে নয়টি গ্রামের অধিবাসীদের নিয়ে একটি ‘জলাধার নির্মাণ কমিটি’ গঠিত হয়। আর ওই কমিটির নেতৃত্বে ৪০০ গ্রামবাসী ২৬ দিন ধরে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে জলাধার নির্মাণ সম্পন্ন করে। এমন বাস্তব উন্নয়ন্মূলক কাজে সমাজের সকলেই উপকৃত হয়, এই সত্য উপলব্ধি করতে পেরে ২৩৮টি গ্রামের অধিবাসীরা এতে যোগ দেন এবং তারা সকলে মিলে ১১০টি জলাধার নির্মাণ করে। যদিও একটি জলাধার কেবল ওই গ্রামের মানুষের উপকারেই আসে, কিন্তু এর নির্মাণে অন্য গ্রামের মানুষেরা শ্রম দিতে পিছ পা হননি। আর মানুষের মধ্যকার এই নতুন মানসিকতা মাওবাদীদের অগ্রসর রাজনৈতিক কর্মসূচীকেই নির্দেশ করে।
এখানে মূলত ওই গ্রামবাসীরা আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে আমিত্বে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। ‘আত্মকেন্দ্রিকতা’ ব্যক্তির ভোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অপরদিকে ‘আমিত্ব’ ব্যক্তির সত্তার সঙ্গে যুক্ত। আমিত্ব না থাকলে ‘আমি’র সত্তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আসবে কী করে? আর ‘আমি’র মুক্তির সঙ্গে জড়িত ‘আমি’র সত্তার পারিপার্শ্বিকতা বা সামষ্টিক মুক্তি। অর্থাৎ, ব্যক্তি যখন কেবল নিজেকে নিয়ে নয় পুরো সমাজটাকেই নিজের মনে করতে শেখে, তখনই তার চিন্তার গণ্ডি ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছায়। আর এমন বাস্তবিক রাজনৈতিক কর্মসূচীর ফলেই মাওবাদীরা সেখানকার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার বদলে আরও সম্পৃক্ত হতে পেরেছেন। আত্মকেন্দ্রিকতা আর আমিত্বের জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনা একেই রাখছি। ওই আলোচনা অন্য কোথাও করা হবে আশা করছি।
১৯৯৭–৯৮ সালের ভয়ঙ্কর খরার সময় জলাধার নির্মাণ কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিদিন প্রত্যেক গ্রামবাসীকে তাদের কাজের বিনিময়ে ১ কেজি করে চাল দেওয়া হয়। জানা গেছে, খরা মোকাবিলার জন্য মাওবাদীরা (তৎকালীন সিপিআই–এমএল পিডব্লিউ) ৪০ হাজার রুপি দিয়েছিল, যার সাহায্যে ৫ হাজার ২০০ কেজি চাল কেনা হয়। এছাড়া জলাধার নির্মাণ কমিটি ধনী কৃষক ও সম্পদশালীদের কাছ থেকে ১ হাজার ৮০০ কেজি চাল সংগ্রহ করে।
পূর্বে যেখানে জলাধার, পুকুর বা অন্যান্য জলের উৎসে থাকা মাছের মালিকানা ছিলো পঞ্চায়েত প্রধানের হাতে, সেখানে জনতন সরকারের অধীনে ওই মালিকানা আসে জনগণের হাতে। আগে গ্রামীণ অভিজাতরা মাছ খাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতো সাধারণ জনগণকে। কিন্তু জলাধার নির্মাণের পর সেখানেই মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৩ সালে বিভিন্ন জলাশয়ে ছাড়া হয় ৩ লাখ মাছের পোনা। ১৯৯৮–৯৯ সালে ৫০ হাজার রুপির ৪ লাখ পোনা গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করা। মাছের পোনা কেনা, বিতরণ ও মাছ বিক্রির পুরো বিষয়টি তদারকি করে বিপ্লবী গণ কমিটি।
মাওবাদীরা প্রথম থেকেই সবজি চাষের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। ১৯৯৬ সাল থেকে সেখানে সবজি চারা বিতরণ শুরু করে। বিভিন্ন গণসংগঠনের মাধ্যমে ২৫০টিরও বেশি গ্রামে টমেটো, বেগুন, আদা, পেঁয়াজ, মরিচ ও বিভিন্ন ফলের চারা বিতরণ করা হয়। তবে প্রথমদিকে মাটির ধরন, চাষ পদ্ধতি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই আশানুরূপ ফলন পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে সেসব ভুল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে ফলন বাড়ানো সম্ভব হয়। গোশালা তৈরি করে গরু–ছাগল পালন, জৈব সার, চালকল ও পানীয় জলের জন্য কুয়ো খনন এবং বনভূমি রক্ষার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।
মাওবাদীরা বিপ্লবী পথে সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবী সমবায়ের বিকাশ ঘটান। উল্লেখ্য, বর্তমান ব্যবস্থায় গঠিত সমবায়গুলো শ্রেণী শোষণের যন্ত্র ছাড়া কিছু নয়। কারণ সেখানে সমবায় পরিচালকমণ্ডলী উদ্বৃত্ত মুনাফা আত্মসাৎ করে, আর সাধারণ সদস্যরা সস্তাশ্রম সরবরাহ করে। এর বিপরীতে দণ্ডকারণ্যে মাওবাদীরা এক নতুন ধাঁচের সমবায় গড়ে তোলেন। যেখানে জনগণই থাকে তার মূলে। আর এর মধ্য দিয়ে জনগণের নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে উঠার সুযোগ ঘটে।
স্বেচ্ছাসেবী এনজিও–র দ্বারা গড়ে উঠা সমবায়গুলো ক্ষমতায়নের কথা বললেও, প্রকৃতপক্ষে সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে এনজিও–র পৃষ্ঠপোষক এলিটদের হাতে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে গড়ে উঠা সমবায়গুলোতে জনগণকে লভ্যাংশের একটা ক্ষুদ্র অংশ দিয়ে কার্যত জনগণের বিদ্রোহী চেতনাকেই দমন করে থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে বাজার অর্থনীতির স্বার্থই রক্ষা করা হয়। ওইসব সমবায়ের কর্তাব্যক্তিরা সামন্ত শক্তিগুলোর ওপর ভরসা করে থাকে। আবার তারা কর্পোরেট সাম্রাজ্যবাদেরও অনুদান পেয়ে থাকে। মাওবাদ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে এসব সমবায়ের মূল কাজ হলো জনগণকে মাওবাদীদের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা এবং বিপ্লবীদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে নিষ্ক্রিয় করা। এদের লক্ষ্য গ্রামাঞ্চলের ভূমিসম্পর্ককে আংশিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে আত্মকেন্দ্রিকতা গড়ে তোলা।
অপরদিকে মাওবাদীদের রাজনীতির ভিত্তিই হলো আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে এমন এক সমাজ নির্মাণ করা, যার ভিত্তি হবে মানবিক মূল্যবোধ, ব্যক্তির মুক্তির জন্যই সামাজিক মুক্তি দরকার, এমন সমাজ মুনাফার ওপর নির্ভশীল নয়। আর এজন্য বিপ্লবী সমবায় আন্দোলনকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এই কর্তব্য সম্পাদনের জন্য বিপ্লবী গণকমিটি বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি সমবায়, শস্য ব্যাংক, বিপনন ও ঋণ সমবায়, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, জনস্বাস্থ্যকেন্দ্র , নারীমুক্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিস্তৃত কর্মসূচী হাতে নিয়েছে মাওবাদীরা।
দণ্ডকারণ্যের সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য মাওবাদীরাই প্রথম সচেতন ও সফলভাবে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছে। ভারতের কথিত স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আদিবাসী অধ্যুষিত ওই অঞ্চলে হয় স্কুলই নেই, অথবা তা অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। শিক্ষক ছিলো না, বিদ্যুৎ ছিলো না, ছিলো নিরক্ষরতা ও কুসংস্কারের আবাস। যেখানে আস্তানা গাড়ছিলো হিন্দুত্ববাদ। এমনি এক অবস্থায় ৯০–এর দশকে মাওবাদীরা বস্তার তথা পুরো দণ্ডকারণ্যে আদিবাসীদের মধ্যে লেখাপড়ার ওপর গুরুত্বারোপ করে। আদিবাসী রাজনৈতিক কর্মীরাই প্রথম স্কোয়াড স্কুলে পড়াশোনা শিখতে শুরু করেন। সেখানে অক্ষর জ্ঞান থেকে শুরু করে মতাদর্শিক পড়াশোনারও ব্যবস্থা করা হয়। পরে ধীরে ধীরে ওই আদিবাসী রাজনৈতিক কর্মীদের মাধ্যমেই শুরু হয় প্রাথমিক স্কুল, মোবাইল একাডেমিক স্কুল (এমএএস), মোবাইল রাজনৈতিক স্কুল (এমওপিওএস)। সেই সঙ্গে চালু হয় আশ্রম স্কুল। যেখানে সুবিধাবঞ্চিতদের পড়াশোনার সঙ্গে বসবাসেরও ব্যবস্থা করা হয়।
ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার, কর্পোরেট মিডিয়া মাওবাদীদের মধ্যে কেবল সহিংসতাই খুঁজে পায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা কেবল অস্ত্র চালাতেই শেখায় না, তা কেন, কোন উদ্দেশ্যে, কার ওপর, কোন পরিস্থিতিতে চালাতে বা না চালাতে হবে, সেই বোধ গড়ে উঠার মতো মানবিক জ্ঞানটুকুও তারা দিয়ে থাকে। আর সেই মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার অন্যতম মাধ্যম শিক্ষা, যার আলো মাওবাদীরা সেখানেও পৌঁছে দিচ্ছেন, যেখানে সূর্যের আলোও ঠিক মতো পৌঁছায়নি।
স্কোয়াড স্কুলে প্রত্যেক নতুন সদস্যকে একটি শ্লেট–পেনসিল দেওয়া হয়। সেখানে স্কোয়াড সদস্যরাই শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিদিনের পড়ার সময়সূচী নির্দিষ্ট থাকে। যেখানে প্রতিদিনের অনুশীলন এবং সকাল–সন্ধ্যায় সমবেত পাঠের ব্যবস্থা থাকে। সমবেত পাঠে পার্টির পত্রিকা বা অন্য কোনো বই পড়া হয়।
মাওবাদীরা যেসব গ্রামেই কাজ শুরু করেছে, সেখানেই প্রাথমিক স্কুল গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। ভ্রাম্যমান স্কুলগুলোতে ভাষা, সমাজবিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও গণিত শেখানো হয়। প্রত্যাকক বিষয় জন্য গোঁড় ও হিন্দি ভাষার পৃথক পাঠ্যবই রয়েছে। ব্যাকরণে মাওবাদীরা বাক্যগঠন, সাধারণ নামপদ প্রভৃতি যেমন শেখায়; তেমনি বিজ্ঞানে তারা পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্রের গঠন, মানব ইতিহাস ও বিবর্তন সম্পর্কে শেখান। এই শিক্ষা আদিবাসীদের যাবতীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধারণা ও অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে লড়তে শেখায়। মাওবাদীদের পরিচালিত স্কুল থেকে শিক্ষা সহায়ক উপকরণ যেমন চার্ট, গ্লোব, টর্চলাইট ইত্যাদি সরবরাহ করা হয়। প্রত্যেক স্কুলে ক্লাসের পর নিয়মিত মূল্যায়ন করা হয়, যার মাধ্যমে শিক্ষকরা বুঝতে পারেন, শিক্ষার্থীদের কেন আর কোন বিষয়গুলো বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। আর এর ওপর নির্ভর করে তারা তাদের শিক্ষা পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনেন।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ১৯৯৭ সালে গড়ে ওঠা ‘চেতনা নাট্য মঞ্চ’ দণ্ডকারণ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০০৬ সালের মধ্যে সম্ভাব্য সব জায়গায় সংগঠনটির শাখা গড়ে উঠেছে। হাজার হাজার আদিবাসী শিল্পী, লেখক, কবি সামন্তবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ–বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গান, নাচ, কবিতা, নাটকের মাধ্যমে নিজেদের নিত্যদিনের সংগ্রাম বর্ণনা করেছেন ও করছেন গ্রামে গ্রামে ঘুরে। এর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে এক সংগ্রামী চেতনা, যা আদিবাসীদের মধ্যে বিপ্লবী সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মাওবাদীদের লড়াই–সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল শহুরে বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে গড়ে উঠেছে ‘দণ্ডকারণ্য রাচাইতাল সংঘম’। এই সংগঠনটির মাধ্যমে আদিবাসী ও মাওবাদীদের সংগ্রামের কাহিনী পৌঁছাচ্ছে শহরের মানুষের কাছে। আবার ওই শহুরে শ্রমজীবী ও মধ্যশ্রেণীর একাংশ জঙ্গলের আদিবাসীদের সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তুলছেন। সেই সঙ্গে আরেকটি সংগঠনের কথা বলা দরকার– ‘বস্তার সলিডারিটি নেটওয়ার্ক’। যা বস্তারে রাষ্ট্রীয় ও হিন্দুত্ববাদী নির্যাতনের বিরুদ্ধে একাত্ম করছে সমগ্র ভারতসহ বিভিন্ন দেশের মানুষদের। এই একাত্মতা পোষণের জন্য মাওবাদী হওয়ার দরকার নেই, দরকার মানবিকতার। অথচ একেও ভারত রাষ্ট্র ‘মাওবাদী প্রচারণা’ বলে আখ্যা দিচ্ছে। ভারত রাষ্ট্রের মোদ্দা কথা, বস্তার তথা দণ্ডকারণ্যের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বললেই আপনি ‘মাওবাদী’।
মাওবাদীদের প্রশ্নে সিএনএন–আইবিএন–এর সাগরিকা ঘোষকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেন, “আমরা যখন মাওবাদী বলি, তখন কাদের বুঝি? ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ কাদের লক্ষ্য করে চালানো হয়? কারণ কারা মাওবাদী আর কারা আদিবাসী এ নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছে। কেউ কেউ মনে করেন, কিছু লোক মাওবাদী আর অন্যরা হলো আদিবাসী। আর কিছু লোক মনে করেন, মাওবাদীরা আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করে। কোনোটাই সত্য নয়। আসল কথা হলো, ওসব এলাকার (মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চল) মাওবাদীদের প্রায় ৯৯ ভাগই আদিবাসী। তবে সব আদিবাসীই মাওবাদী নয়। অবশ্য এটাও সত্য যে লাখ লাখ মানুষ মাওবাদী হিসেবেই নিজেদের ঘোষণা করেন। প্রায় ৯০ হাজার নারী এখন তাদের নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত, ১০ হাজার সাংস্কৃতিক সংগঠন তাদের সঙ্গে জড়িত। তবে কি তাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে?”
তিনি ওই সাক্ষাৎকারে আরও বলেন, “যাকেই ভিন্ন মতালম্বী মনে হবে, তাকেই মাওবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার একটা মারাত্মক প্রবণতা দেখা যায়। হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা লোককে তুলে নিয়ে কারাগারে রাখা হয়েছে। জঙ্গলের বাইরে থাকা অহিংস আন্দোলন থেকে শুরু করে জঙ্গলের ভেতরে সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক মানুষকে নির্বিচারে কর্পোরেট হামলার শিকার করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমনটা ঘটেনি।”
এগারো.
অরুন্ধতী রায়ের সংগ্রামী ঝুলিতে এখন পর্যন্ত সর্বশেষ সংযোজন তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’। প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ প্রকাশের ২০ বছর পর এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের জুনে। যার পরিধি ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলজুড়ে বিস্তৃত।
অরুন্ধতীর দুটো উপন্যাসই বস্তুত আত্মজীবনীমূলক। ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’–এ উঠে এসেছে তাঁর পরিবার, পারিবারিক আবহ ও সমাজে ছোটবেলা থেকে জাতিবর্ণের শোষণ প্রত্যক্ষ করার বয়ান। ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ উপন্যাসে উঠে এসেছে অরুন্ধতীর বিস্তৃত সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও বহুধা বিভক্ত সমাজে তাঁর দেখা সাধারণ মানুষের জীবন–সংগ্রামের আখ্যান। যেখানে আছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, শোষণ, জাতি–বর্ণের বিপরীতে প্রেম, আশাবাদ আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
সাড়ে চারশো পৃষ্ঠার ওই উপন্যাসে লিও তলস্তয়, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বা এদুয়ার্দো গ্যালিয়ানোর ছায়া পাওয়া যায়। উপন্যাসের চরিত্রগুলো বাস্তব জীবন থেকে উঠে এসেছে। যে মানুষগুলো আমাদের পাশের বাস করে, অথবা আমাদের মাঝেই বসত ওই চরিত্রগুলোর। চরিত্র নির্মাণে মার্কেজের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আবার চরিত্রগুলোর বাস্তবতা, পারিপার্শ্বিক সামাজিক আবহ তুলে ধরার ক্ষেত্রে কখনো তলস্তয়, কখনো ডিকেন্সের কথা মনে পড়তে পারে। আবার গল্প বলার ধরণে গ্যালিয়ানোর মন্ত্রমুগ্ধতার ছোঁয়া পাওয়া যায়। যা পাঠককে ভারতজুড়ে ছড়ানো গল্পের গভীরে টেনে নেবে। একই ধাঁচের না হলেও অরুন্ধতী তাঁর উপন্যাসে যে রাজনৈতিক তীর্যক বক্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন ভারতের কথিত ‘সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের’ দিকে, তা ম্যাক্সিম গোর্কির সঙ্গে তুলনীয়। গোর্কি বলতেন, “সাহিত্যের কাজ হলো ক্ষমতাহীন ও দুর্বল মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠা।” অরুন্ধতী সাধারণ মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি নির্মাণ করে সে কাজটাই করেছেন।
২০১৭ সালের ১৯ জুন নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন একাডেমি অব মিউজিকের অপেরা হাউসে ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’–এর পাঠ পরবর্তী এক আলাপচারিতায় অরুন্ধতী রায় বলেন, “লেখক যদি তাঁর সমাজ নিয়ে না লেখেন– যে সমাজ অসাম্য, বিভক্তি ও নিবর্তনে জর্জরিত– তাহলে অন্য আর কী নিয়ে তিনি লিখবেন? আর এর নাম যদি রাজনীতি হয়, তাহলে তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।”
তবে অরুন্ধতীর মতে, “সবকিছুই রাজনৈতিক। এমনকি একটি গোল্ডফিশের যৌনজীবনও রাজনৈতিক। আমার এই উপন্যাসের পরতে পরতে রাজনীতির আবহ আছে। তাই একে আলাদা করে রাজনৈতিক উপন্যাস বলার প্রয়োজন নেই।”
এ প্রসঙ্গে ২০১৭ সালের ২০ জুন ডেমোক্র্যাসি নাউ–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী বলেন, “উপন্যাসের একটা বিপদ হলো ঘরকুণো হয়ে পড়া। আপনি জানেন, বিষয়বস্তুটা হতে হবে ভীষণ শক্তিশালী, যা দ্রুত ব্যক্ত করতে হবে, ছক কেটে শেলফে রাখতে হবে এবং সবাইকে জানতে হবে বিষয়বস্তুটা কী। আমি সেটাকে ভেঙে বেরোতে চাই। বিষয়বসবস্তুটা কী? তা হলো সেই বাতাস, যাতে আমরা নিশ্বাস নিই। বিষয়বস্তুটা হলো রাজনীতি, যেটা আমাদের জীবনে প্রতিনিয়ত প্রভাব ফেলে। এগুলো শুধু খবরের পাতার হেডলাইন নয়। কাশ্মীরে কী হচ্ছে, অথবা উচ্ছেদ হওয়া লোকগুলোর পরিণতি কী হলো, অথবা তাদের পার্শ্ববর্তী স্থানগুলোয় কী হচ্ছে– এগুলোকে একসঙ্গে এক উপন্যাসের জগতে উপস্থাপন করা যায়, কারণ অন্য কোনোভাবে আপনি তা করতে পারবেন না।”
গুজরাট গণহত্যা থেকে কাশ্মীর, বস্তার থেকে গোরক্ষা পর্যন্ত বিস্তৃত এই রাজনৈতিক উপন্যাসটির পরিধি। বিশাল ব্যাপ্তির এই উপন্যাসে প্রায় ৪০টি চরিত্র রয়েছে। তবে দুই কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রের গল্পকে অবলম্বন করেই উপন্যাসের কাহিনী এগিয়েছে। একদিকে দিল্লির এক ‘হিজড়ে’ আনজুমের আত্মোপলব্ধী, অপরদিকে স্থাপত্যকলার শিক্ষার্থী তিলোত্তমা ও তার কাশ্মীরি প্রেমিক মুসার সংগ্রামের কাহিনী। উপন্যাসের শুরুতেই আনজুমের জন্মের বর্ণনা দেওয়া হয়। জন্মের পর তাঁর নাম দেওয়া হয় আফতাব। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠার পর্যায়ে আফতাব নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। পরে তিনি আনজুম নামটি গ্রহণ করেন।
বায়োলজিক্যাল না হলেও জয়নাব আনজুমের সন্তান। জয়নাবের পাণিপ্রার্থী সাদ্দাম হোসেন। তাঁর দলিত বাবা ও চাচাকে গোহত্যার মিথ্যা অভিযোগে ‘গোরক্ষক’ নামধারী হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা হত্যা করে। উপন্যাসে দেখা যায়, জয়নাব সাদ্দামের বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করে। আনজুম গুজরাট গণহত্যার সময় এই গায়ত্রী মন্ত্র শিখেছিলেন। পরে তিনি জয়নাবকেও তা শেখান। তিলোত্তমা স্থাপত্যকলার শিক্ষার্থী ছিলেন। এই চরিত্রটি অরুন্ধতী নিজের আদলেই নির্মাণ করেছেন। তিলো গান শেখান, একজন অ্যাক্টিভিস্টও।
আনজুমের ‘জান্নাত’ নামের আবাসস্থলটি আসলে একটি পুরনো কবরস্থান। চার্চ অস্বীকৃতি জানালে তিলোর মাকে এখানেই সমাহিত করা হয়। ‘জান্নাত’–এর বিশাল পরিবারের অংশ মিস জেবিন দ্য সেকেন্ড, যার মা একজন কমিউনিস্ট, দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টির কর্মী থাকাকালীন পুলিশের ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন আর সন্তানটিকে যন্তরমন্তরে একত্রিত হওয়া প্রতিবাদী জনতার মাঝে রেখে যান।
শিশুটিকে উদ্ধারের বিবরণে উপন্যাসে বলা হয়– “কংক্রিটের মেঝেতে, একগাদা ময়লার মাঝে– সেখানে সিগারেটের সোনালি ফয়েল, কিছু প্লাস্টিক ব্যাগ, চিপসের খালি প্যাকেট পড়ে আছে– সেখানে আলোর বন্যার মধ্যে, উড়ন্ত মশার দঙ্গলের তলায় নগ্ন কন্যা শিশুটি শুয়ে আছে। তার ত্বক নীলাভ–কালো, শিশু শিল মাছের মতো মসৃণ।” জেবিন দ্য সেকেন্ড তিলোর পালিত সন্তান।
তিলোত্তমার প্রেমিক একজন কাশ্মীরি মুক্তিকামী নেতা, মুসা। উপন্যাসের প্রথম অংশটি আনজুমকে ঘিরে আবর্তিত হলেও, পরবর্তীতে প্রাধান্য পায় তিলোত্তমা ও তাঁর পারিপার্শ্বিক অবস্থান। তিলোর তিন বন্ধু নাগা, গারসন হোবার্ট ওরফে বিপ্লব দাসগুপ্ত এবং মুসা। তিলো নাগাকে বিয়ে করেছিলেন, কিন্তু তা কয়েক বছর পর ভেঙে যায়। মুসার বর্ণনা উঠে আসে বিপ্লব দাসগুপ্তের বয়ানে। মুসার স্ত্রী আরিফা ও একমাত্র সন্তান মিস জেবিন দ্য ফার্স্ট–কে ভারতীয় সেনাবাহিনী গুলিতে হত্যা করে।
অরুন্ধতী রায় এ উপন্যাস সম্পর্কে বলেন, “বিক্ষিপ্ত জীবনের খণ্ড খণ্ড কিছু গল্প বলেছি আমি। এসবের মধ্যে দৃশ্যত কোনো সংযোগ নেই। আবার গভীরভাবে ভাবলে অনেক সংযোগ আছে।”
গুজরাট গণহত্যা, কাশ্মীরে সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যাযজ্ঞ, তার বিবরণ ও সাক্ষীদের জবানবন্দী, আদিবাসীদের সংগ্রাম, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ এবং জাতিবর্ণের থাবা– এ উপন্যাস পাঠককে এক ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। যেখানে ফুটে উঠে তীব্র বৈষম্যপূর্ণ এক সমাজ কায়েম করে ভারত রাষ্ট্র গণতন্ত্রের নামে কার্যত জনগণের ওপর এক সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। যার ব্যাপ্তি ক্রমবর্ধমান। আর এই বাস্তবতা তুলে ধরার কারণেই অরুন্ধতী এক অসাধারণ সাহিত্যকর্ম সৃষ্টিতে সফল হয়েছেন।
২০১৭ সালে ডেমোক্র্যাসি নাউ–এর নেরমীন শেখ এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি বইটার নাম রেখেছেন ‘দ্য মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস’, এই নাম রাখা এবং তার সঙ্গে বইটাকে উৎসর্গ করা নিয়ে কিছু বলুন। বইটা উৎসর্গ করা হয়েছে ‘সহানুভূতি না পাওয়াদের প্রতি’।”
এর জবাবে অরুন্ধতী রায় বলেন, “গোপনে আমরা সবাই কিন্তু এমনটাই। যদি আমরা তা প্রকাশ না করি তাহলেও। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ করেন, বাকিরা করেন না। কিন্তু আমার মনে হয় পুরো পৃথিবীটাই বর্তমানে সহানুভূতি না পাওয়াদের দলে রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন নামটা বিদ্রুপাত্মক, আসলে নামটা কিন্তু বিদ্রুপাত্মক নয়। আমার মনে হয়, বস্তুত মানুষ হিসেবে বর্তমানে আমাদের সুখ অর্জনের পথ, প্রগতির পথ বা সভ্যতা সম্পর্কে প্রচলিত সংজ্ঞাগুলো নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন। এ বইয়ের গল্পটা তাদের নিয়ে, যারা বোঝেন যে, এটা ক্ষণস্থায়ী। সুখে থাকার মানে কোনো ভবন বা প্রতিষ্ঠান নয়, যা চিরকাল থাকবে। এটা ভঙ্গুর। যখন সম্ভব আপনি এটাকে উপভোগ করতে পারেন, আর আপনি তাকে সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত জায়গাতেও খুঁজে পেতে পারেন।”
শ্রেণীবিভক্ত সমাজে কোনো মানুষ বা কোনো সাহিত্যকর্ম শ্রেণীর ঊর্ধ্বে নয়। আর অরুন্ধতীর এই উপন্যাস যে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে এক তীব্র কষাঘাত, তা ওই শ্রেণীর সাহিত্যিক, সমালোচকদের সমালোচনা দেখেই আঁচ করা সম্ভব। ওই সমালোচকদের মতে এই উপন্যাস নাকি রাজনৈতিক প্যামফ্লেট, এটি নাকি উপন্যাস হয়ে উঠেনি! এমনটা হলে তো গোর্কি, তলস্তয়, মার্কেজরা সব খারিজ হয়ে যান। অরুন্ধতী উপন্যাস লেখার গতানুগতিক ফর্মটাও ভেঙেছেন দ্য মিনিস্ট্রি অব আট্মোস্ট হ্যাপিনেস’–এ। তিনি এখানে কথিত ফর্ম বজায় রাখতে গিয়ে রাজনৈতিকতা অবদমনের চেষ্টা করেননি। কোনো চরিত্রকে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে তিনি যেভাবে দেখেছেন, সেভাবেই চরিত্রটিকে উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে অরুন্ধতী আবারো সমাজের নিপীড়িত শ্রেণীসমূহের পক্ষে তাঁর অবস্থানের জানান দিলেন।
সমকালীন ভারতে এমন রাজনৈতিকতা সম্পন্ন উপন্যাস একদমই চোখে পড়েনি। আর তা সম্ভব হয়েছে অরুন্ধতীর রাজনৈতিকতা বিকাশের ফলেই। কোনো লেখক তাঁর বাস্তবতা এড়িয়ে লিখতে পারেন না। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে চিন্তাশীল মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক। আর রাজনৈতিক অবস্থান ও তার বিকাশই লেখককে লেখার জীবনীশক্তি দান করে। নিজের ধারণ করা রাজনৈতিকতা বা যাপিত জীবনের বাইরে লিখতে গেলে, তা নিশ্চিতভাবেই স্বাভাবিকতা হারায়। সংগ্রামী চেতনার ফলেই সাধারণের রাজনৈতিকতা উঠে এসেছে অরুন্ধতী রায়ের ক্ষুরধার লেখনিতে। আর এখানেই অনন্য অরুন্ধতী।।
জানুয়ারি ২০১৮
[অরুন্ধতী রায়ের বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত কিছু লেখা, বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারের “অরুন্ধতী রায়ের চিন্তাবিশ্ব” শীর্ষক অনুবাদ সংকলনে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। শারমিনুর নাহারের সম্পাদনায় বইটি ২০১৮ সালের বইমেলায় প্রকাশ করেছে সংবেদ প্রকাশনী।]