লিখেছেন: সব্যসাচী গোস্বামী
প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসার পর মোদি প্রত্যাশিতভাবেই সাংস্কৃতিক জগতেও তার ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ চালু করে দিয়েছে। সম্প্রতি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে প্রয়াত হয়েছেন সাংবাদিক এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা শুভ্রদীপ চক্রবর্তী। মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তিনি ‘ইন দিনো মুজাফরনগর’ নামে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তথ্যচিত্রটিতে সাম্প্রতিক মুজাফরনগরে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার পিছনের রাজনীতিটিকে উন্মোচিত করা হয়েছিল। স্বভাবতই এর ফলে আঙুল উঠছে সংঘ পরিবারের দিকে, তাই মোদি ক্ষমতায় আসার পরই দেখা গেল সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশানের পক্ষ থেকে ছবিটির ক্লিয়ারেনস আটকে গেল! শুধু তাই নয়, এর বিরুদ্ধে তিনি যখন ফিল্ম সার্টিফিকেশান এপিলেট ট্রাইবুনালে গেলেন, তখন সেখানেও তার জন্য দরজা বন্ধ হয়ে গেল। তথ্যচিত্র নির্মাতার অভিযোগ যে, তথ্যচিত্রটিকে বন্ধ করতে স্বয়ং মোদি তৎপর হয়েছিলেন।
একইভাবে আবার দেখা যাবে, বিজেপি ঘনিষ্ট দিননাথ বাত্রাকে, যাকে আঞ্চলিক প্রচারমাধ্যমগুলি ‘বুক পুলিশ’ (book police) এবং ‘ব্যান ম্যান’ (Ban Man) বলে ডেকে থাকে, তিনিও উঠে পরে লেগেছেন হিন্দুত্ববিরোধী কোন বই প্রকাশিত হলে তা নিষিদ্ধ করতে। বস্তুতঃ তার কার্যকলাপ হলো কোন্ বই হিন্দুত্ববাদ বিরোধী মনে হলেই তিনি প্রকাশককে আইনী নোটিশ পাঠান যে, আপনার বইটি হিন্দু ধর্মের ভাবাবেগকে আঘাত করছে অতএব…। সম্প্রতি চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েন্ডি ডোনিগার (Wendy Doniger)-এর একটি বইকে নিষিদ্ধ করতে তৎপর হয়েছেন। বাত্রা কিছু সমমনোভাবাপন্ন শিক্ষক, উকিলদের নিয়ে একটি ‘শিক্ষা বাঁচাও কমিটি’ বানিয়েছেন। তিনি গর্ব করে বলেন যে, “আমাকে সবাই ‘ব্যান ম্যান’ যতই ডাকুক, যারা হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করবেন, তাদের আমরা বাধা দিয়ে যাব …গবেষণার নামে আমাদের হিন্দু ধর্মকে বা আমাদের ধর্মের দেব–দেবীকে অপমান করাকে আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না।” এই দিননাথ বাত্রাই আবার নরেন্দ্র মোদির এত পছন্দের লোক যে, মোদি গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাট সরকার তাঁর ৯টি বই পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই বইগুলির কয়েকটার মুখবন্ধ লিখেছেন আবার নরেন্দ্র মোদি স্বয়ং। বইগুলোতে হিন্দু ধর্মের গরিমা দেখাতে গিয়ে উদ্ভব সব বিষয়বস্তুতে ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া লেখাগুলি উচ্চবর্ণবাদী সাম্প্রদায়িক এমন সব কথায় ভরপুর, যে কোন সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষকদের পক্ষে তা পড়ানো অসম্ভব। পরে অবশ্য জনমতের চাপে বইগুলোকে তুলে নিতে গুজরাট সরকার বাধ্য হয়। বাত্রার বইগুলি কতটা উদ্ভট ছিল তার উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, তিনি সংস্কৃত ভাষার আধিপত্যের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে যে কোন কথ্য হিন্দুস্তানি ভাষাকেই বিদেশী উৎসের কারণে আপত্তি করেছেন।আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের শরীরের কৃষ্ণবর্ণকে তিনি মোষের চামরার সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রাচীন ভারতের গরিমাকে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি দাবী করেছেন প্রাচীন ভারতীয়রা নাকি মহাভারতের যুগেই স্টেমসেল পদ্ধতিতে চিকিৎসার মূল সূত্রগুলি আবিস্কার করেছিলেন, কিংবা সেই সময়ই নাকি ভারতীয়রা মোটর গাড়ির, এরোপ্লেন ইত্যাদীর ব্যবহার জানত। তিনি তার পাঠ্যবইয়ে এটাও লিখেছিলেন যে, গো–সেবা করলে বন্ধ্যা নারী নাকি সন্তান লাভ করতে পারে। দিননাথ বাত্রা বেসরকারিভাবে একটি সমান্তরাল শিক্ষা কমিশন চালিয়ে যাচ্ছে। যার লক্ষ্য হলো – শিক্ষার ‘ভারতীয়করণের’ জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। বাত্রা সম্প্রতি দাবী করেছেন, এদেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী তাকে নাকি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শিক্ষায় ভারতীয়করণ (পড়ুন গৈরিকীকরণ) নিয়ে প্রদত্ত তাঁর প্রস্তাব সরকার বিবেচনা করবে। আমাদের দেশের কর্পোরেট মিডিয়ার ‘পোষ্টার বয়’ নরেন্দ্র মোদী এই বাত্রার উদ্ভট ইতিহাস ভাষ্য দ্বারা এতোটাই প্রভাবিত যে, প্রধানমন্ত্রীর কুরসীতে বসার পর গত ২৫শে অক্টোবর ২০১৪, স্যর এইচ এন রিলায়েন্স ফাউন্ডেশান হসপিটালের উদ্বোধন করতে গিয়ে মোদি বলেছেন – “মহাভারতে আছে কর্ণ মাতৃগর্ভে জন্মাননি। তার মানে সেই সময় জেনেটিক বিজ্ঞানের অস্তিত্ব ছিল। …আমরা গনেশজীর পূজা করি, ঐ সময় নিশ্চয়ই কোন প্লাস্টিক সার্জন ছিলেন, যিনি মানুষের শরীরে হাতির মাথা জুড়ে দিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি প্রথম শুরু করেছিলেন।” (সূত্রঃ ১লা নভেম্বর ২০১৪, দ্য হিন্দু পত্রিকায় লেখা বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপারের নিবন্ধ)
কিছুদিন আগে একই মন্তব্য করেছেন মোদি মন্ত্রীসভার আরেক পন্ডিত, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনি বলেছেন, “ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম ফিজিক্স–এর ‘প্রিনসিপ্ল অফ আনসার্টেনিটি’ তত্ত্ব আসলে বেদ থেকে নেওয়া।” (সূত্রঃ ১৮ই নভেম্বর ২০১৪, এই সময়) এই হিন্দুত্ববাদী মুর্খগুলো জানেও না যে, বিজ্ঞানের বিকাশের প্রশ্নটা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির দ্বন্দ্বে, মানুষের আধিপত্যের সাথে যুক্ত একটা ব্যাপার। উৎপাদিকাশক্তির বিকাশের সাথে এর ওতপ্রোত সম্পর্ক। উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে বিছিন্ন হয়ে কোনমতেই বিজ্ঞানের বিকাশ সম্ভব নয়। আমরা আগেই বলেছি বৈদিক যুগে আর্যরা শুরু দিকে ছিল একেবারে পশুপালনের স্তরে। উপনিষদের যুগে এসে সবেমাত্র কৃষিকার্যে তারা মনোনিবেশ করেছে। গোটা ঋগ্বৈদিক যুগে তাদের শ্লোকগুলো প্রকৃতির কাছে অসহায় আত্মসমর্পনের প্রতিফলন। এরকম একটা সমাজে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের তত্ত্ব খুঁজতে পারে কিংবা মহাভারতের যুগে বিজ্ঞানের আজকের বিরাট বিরাট আবিস্কারগুলো খুঁজে পেতে পারে একমাত্র তারাই, যাদের মস্তিষ্কে ভারসাম্যহীনতার সমস্যা আছে। এইসব মানুষের নেতৃত্বে আধুনিক ভারত গড়ে উঠতে পারবে, মাফ করবেন এতোটা কষ্টকল্পনা করার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই!
ইতিহাসের বিকৃতকরণের ঘটনাটা অবশ্য নতুন নয়। সাভারকার থেকে হেডগেওয়ার হয়ে গোলওয়ালকর – বাজপেয়ি, আদভানি হয়ে আজকের নরেন্দ্র মোদি প্রত্যেকেই সুযোগ পেলেই এই ইতিহাস বিকৃতকরণে কোমর বেঁধে নেমেছে বারবার। ঘটনা এটাই যে, প্রাচীন হিন্দুদের কোন ইতিহাস লেখার অভ্যাসই ছিল না। এ বক্তব্য শুধুমাত্র আমার নয়, খোদ জওহরলাল নেহেরুর মতো শাসকশ্রেণীর প্রতিনিধিদের। তিনি তাঁর ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়ায় এ কথা স্বীকার করেছেন। মুসলমান শাসকরা বাইরে থেকে এদেশে আসার সময় তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বৌদ্ধ পরিব্রাজকদের হাত ধরে প্রথম এদেশের ইতিহাস লেখা শুরু হয়। ব্রিটিশরা এসে প্রথম তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াতে বিকৃতভাবে এদেশের ইতিহাস লেখা শুরু করে। হিন্দুত্ববাদীরা এক্ষেত্রে ছিল তাদের দেশীয় দোসর। রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রথমবার বসার পর বাজপেয়ি সরকারের আমলে ইতিহাসের বিকৃতিকরণের লক্ষ্যে আইসিএইচআর–এর নিয়োগে সরাসরি তারা হস্তক্ষেপ করেছিলেন। আইসিএইচআর থেকে বাদ পড়েছিলেন অধ্যাপক সুমিত সরকার, অধ্যাপক কে.এম পানিক্কর, অধ্যাপক রোমিলা থাপার প্রমুখ প্রখ্যাত ইতিহাসবিদরা। তাদের সরিয়ে আনা হয়েছিল বি.আর গ্রোভার, এম.ভি শ্রীনিবাসকে। এঁরা বাবরি মসজিদের তলায় মন্দির ‘আবিস্কার’ করেছিলেন কোন রকম তথ্যপ্রমাণাদি ছাড়াই। অযোধ্যা অঞ্চলে হিন্দুদের দ্বারা বৌদ্ধ মঠগুলো ধ্বংসের প্রমাণকে নসাৎ করেছিলেন। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিকরা বহু ফিল্ড ওয়ার্ক করেও সরস্বতী নদীর কোন প্রমাণ পাননি, তবুও তারা সে সময় সরস্বতী নদী ‘আবিস্কার’ করেছিলেন। বাজপেয়ির আমলে হরি গৌতমের মতো সংঘ মনস্করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায় নিযুক্ত হয়েছিলেন, যারা জ্যোতিষ শাস্ত্র, বাস্তুতন্ত্র, বৈদিক গণিত ইত্যাদির আড়ালে শিক্ষায় গৈরিকীকরণে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
বর্তমান মোদি সরকার আবার একই কাজ শুরু করেছেন। সম্প্রতি আর এস এসের নেতা সুরেশ সোনি এবং দত্তাত্রেয় হোসবলে সহ বিভিন্ন শাখার নেতারা কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানীর সঙ্গে প্রায় সাত ঘন্টা বৈঠক করেছেন। সংঘ পরিবারের দাবী মেনে ইতোমধ্যেই মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বেদ, উপনিষদ পড়ানোর জন্য একটা বিশেষ কমিটি গড়েছে। সংঘ নেতা সুরেন্দ্র জৈনের সুপারিশ মেনে কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক প্রযুক্তি শিক্ষার অন্যতম এলিট প্রতিষ্ঠান আইআইটি–গুলিকে নির্দেশ দিয়েছে কিভাবে আমিষ ক্যান্টিন আর নিরামিষ ক্যান্টিন আলাদা করা যায় তা দেখতে। অর্থাৎ সরকার দায়িত্ব নিয়ে ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে ছোঁয়াছুঁয়ির বাছ–বিচার শেখাচ্ছে।
এখানেই তাদের কুকীর্তির শেষ নয়, তারা ইতিহাস গবেষণা পরিষদ তথা আইসিএইচআর–এর চেয়ারম্যান হিসাবে মাথায় বসিয়েছেন আরএসএস–এর অন্যতম সংগঠক সুদর্শন রাওকে। এই রাওয়ের সে অর্থে এই সংস্থার চেয়ারম্যান হবার মতো শিক্ষাগত কোন যোগ্যতাই নেই। কোন খ্যাতনামা জার্নালে আজ অবধি তার লেখাপত্র প্রকাশিতও হয়নি। তার একটাই যোগ্যতা ইতিহাসবিদ হিসাবে তিনি উচ্চবর্ণীয়, ব্রাহ্মণ্যবাদী, হিন্দু সাম্প্রদায়িক চিন্তার মতাদর্শের একজন একনিষ্ট সেবক। তিনি তার নিজস্ব ব্লগে লেখা প্রবন্ধগুলো দ্বারা ভারতের জাতিবর্ণ ব্যবস্থার মহিমাকে প্রচার করেছিলেন।
আধুনিক ভারতের কথা বলে আজ মোদি সরকার যেভাবে প্রাচীন ভারতের মহিমা প্রচারে নেমেছেন, তার বিরুদ্ধে অবিলম্বে সচেতন বিজ্ঞান মনস্ক প্রতিটি মানুষের সোচ্চার হওয়া দরকার। সব দেখে কবি জীবনানন্দ দাসের কবিতা ধার করেই বলতে ইচ্ছা করে – অদ্ভুত আঁধার এক নেমে এসেছে এ পৃথিবীতে আজ…