অনুবাদ: শাহেরীন আরাফাত
[কমরেড কিরণ, ভাইস চেয়ারম্যান, কেন্দ্রীয় কমিটি, ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওবাদী); সম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেন পার্টির ভেতরে চলমান ২ লাইনের সংগ্রাম, নতুন সংবিধান রচনা, নেপালী কংগ্রেসের মতো প্রতিক্রিয়াশীল সংসদীয় দল এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ প্রসঙ্গে।]
প্রশ্ন: গত দুই বছর যাবৎ জাতীয় সংবিধান রচনা এবং নেপালি কংগ্রেসের মতো ডানপন্থি প্রতিক্রিয়াশীলদেরবাধার অভিজ্ঞতা; অতীতের ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষিতে আপনি একে কিভাবে বর্ণনা করবেন?
কমরেড কিরণ: গণপরিষদে আমাদের গত দুই বছর এবং নেপালি কংগ্রেস সহ সংসদের অন্যান্য দলগুলোর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই জটিল ও তিক্ত। এই পুরো প্রক্রিয়ায়দু’টি পরস্পর বিপরীত ধারার তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম বিদ্যমান ছিল: পিএলএ’কে একটি সম্মানিত, গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে একীভূত করে একটি নতুন জাতীয় সেনাবাহিনী গঠিত হবে, নাকি তাদের নিরস্ত্র করে আত্মসমর্পণ করানো হবে; গণ–মানুষের সংবিধান কি সামন্তবাদ বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হবে, নাকি সামাজিক পদমর্যাদা অনুযায়ী একটি সাংবিধানিক সংবিধান রচিত হবে। এই সংগ্রামে আমাদের পার্টি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে।
অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই ভাবে বিভিন্ন সমঝোতা ও চুক্তির মূল্যায়নের ভিত্তিতে একটি গুরুতর দুই লাইন সংগ্রাম সংঘটিত হচ্ছে।
প্রশ্ন: ভারতে আপনাদের বন্ধু, ভারতীয় মাওবাদীরা তৎকালীন বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরাস্ত না করেই আপনাদের সংসদীয় পথে হাঁটার ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আপনার পার্টি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের বিধানসভায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র যন্ত্রকে পুনর্বিন্যাস করতে চেয়েছে। অতীতচারণপূর্বক আপনি তা কিভাবে দেখেন?
কমরেড কিরণ: আমাদের দল পুরনো রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে একটি নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য জনযুদ্ধ শুরু ও তা পরিচালনা করেছে। তা সত্ত্বেও এই কাজ পূর্ণ না করে আমরা আপস করেছি এবং রাষ্ট্র পূনর্গঠনকারী এক নীতি গ্রহণ করেছি। আমরা একে আমাদের সীমাবদ্ধতা এবং বাধ্যবাধকতা হিসেবে মেনে নিয়েছি। ভারতীয় মাওবাদীদের আমাদের দল সম্পর্কে সংশয়ী হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আগামীদিনে আমাদের দলের অনুশীলনের মাধ্যমেই ভারতীয় কমরেডগণের সন্দেহের প্রাসঙ্গিকতা বা ন্যায্যতা সম্পর্কে সঠিক উত্তর দিতে হবে।
প্রশ্ন: আপনার দেশ দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাশক্তিভারত এবং চীনের মাঝখানে স্যান্ডুইচে পরিণত হয়েছে। বিপ্লবী জোয়ারের জন্য আপনার পার্টি চীন থেকেও ভারতকে বেশী ক্ষতিকর মনে করছে। পরবর্তীতে আপনাদের পার্টি চেয়ারম্যান প্রচণ্ড, ভারত বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে ভারতের সাথে আরো বেশী বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থান নেন।এই দ্বৈততাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
কমরেড কিরণ: হ্যাঁ, আমাদের দেশ ভারত এবং চীনের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দুই পরাশক্তির মাঝখানে স্যান্ডুইচে পরিণত হয়েছে। আমরা এই দুই দেশের সাথেই পারষ্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে জাতীয় অখণ্ডতা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। ১৯৫০’এর নেপাল ও ভারতের মধ্যে চুক্তিসহ এমন বিভিন্ন অসম চুক্তি রয়েছে ভারতের সাথে। কিন্তু চীনের সাথে আমাদের কোন অসম চুক্তি নাই। এই অর্থেআমরা ভারতীয় শাসক শ্রেণীর সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের বিরোধিতা করি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, আমরা ভারতীয় গণমানুষের বিরোধিতা করি। আমরা সকল অসম চুক্তি রদ করে উভয় দেশের পারস্পরিক আগ্রহ ও সমতার উপর ভিত্তি করে নতুন চুক্তি সম্পাদন করতে আগ্রহী।
আমি মনে করি ভারতের বিষয়ে পার্টির চেয়ারম্যান প্রচণ্ড’র মতামতের উপর নির্ভর করাএবং তার দ্বৈতবাদিতা অনুশীলন করা কখনোই সঠিক নয়। তিনি যেভাবে তার (প্রচণ্ড) সীমাবদ্ধতা, অথবা সঠিকভাবে কূটনীতি ও রাজনীতির মধ্যে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যররথতা প্রকাশ করলেন; তাতে একটি প্রশ্ন অবশ্যই রয়ে যায়।
প্রশ্ন: আপনার দল কি এখনও ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সত্তা ও জাতীয় আকাঙ্খার জন্য হুমকী স্বরূপ একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র মনে করে?
কমরেড কিরণ: হ্যাঁ, আমরা এখনও তাই মনে করি।আমাদের এই অবস্থান শুধুমাত্র ভারতীয় সংখ্যালঘু শাসকশ্রেণীর জন্য। আমরা পুরো ভারতবাসীর দৃষ্টিকোণ থেকে সমতা চাই, আর আমরা মনে করি নেপালের বিপ্লবের জন্য তারা আমাদের বন্ধু।
প্রশ্ন: নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সময়সশস্ত্র পন্থা ত্যাগ করে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের কাহিনী ফাঁদা হয়। আপনারা তখন শহুরে সমাবেশের একীকরণের তত্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
কমরেড কিরণ: হ্যাঁ, আমরা এই পথ গ্রহণ করেছিলাম; অথবা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পথ সশস্ত্র পন্থায় পুরোনো রাষ্ট্র ক্ষমতা ধ্বংসের পথ থেকে আমাদের সরিয়ে দিয়েছিল। এখানেআমদের অনেক ত্রুটি–বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা রয়েছে, আমরা তা স্বীকার করেই ক্ষমাহীনভাবে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।
একীভুত করে শহুরে বিদ্রোহ সংগঠিত করার যে ধারনা গৃহীত হয়েছে, তা সঠিক এবং আরো ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের উন্নতির প্রেক্ষাপটে আমরা একীভুত করার এমন একটি ধারণা তৈরী করার চেষ্টা করছি যাতে সশস্ত্র বিদ্রোহের কিছু কার্যপদ্ধতি দীর্ঘায়িত গণযুদ্ধে অন্তর্গত হবে, আর তা হলো এর প্রধান দিক। আরো অধিক অধ্যয়ন এবং বাস্তবিক প্রয়োগ; এর উভয় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয়। পার্টিকে ডান সংশোধনবাদের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটা ঝুঁকি তৈরী হয়েছে এবং আমরা এ সম্পর্কে অবগত আছি। ধন্যবাদ।
(সুত্র: নিউ ডেমোক্রেটিক পিপলস ফ্রন্ট
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন: সুথাগর ও পিটার
সৌজন্যে: দি নেক্সট ফ্রন্ট)